শফিকুল হক :: বাংলাদেশের ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের প্রতি একটি নীতিগত ও প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য ও প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই প্রস্তাবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation – PR) পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে বহু আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে সফলভাবে প্রয়োগ হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা কিছু ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও, তা দেশের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে না। তাই এই প্রস্তাবে একটি “মিক্সড-মেম্বার প্রপোরশনাল” (Mixed-Member Proportional – MMP) পদ্ধতি গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে, যা বর্তমান ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতির সঙ্গে আনুপাতিক ভোটের সমন্বয় ঘটিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত মডেল তৈরি করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে ভোটার দুটি ভোট প্রদান করবেন—একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীর জন্য, অপরটি একটি রাজনৈতিক দলের জন্য। প্রার্থীর ভোটে স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকবে, আর দলীয় ভোটের মাধ্যমে সংসদে আনুপাতিকভাবে আসন বণ্টন নিশ্চিত হবে। এভাবে একদিকে যেমন ভোটারদের পছন্দের প্রতিফলন ঘটবে, অন্যদিকে রাজনৈতিক বৈচিত্র্যকেও যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডে এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগ দেখা গেছে। এমনকি তুরস্কের অভিজ্ঞতা থেকেও শেখার সুযোগ রয়েছে, যেখানে PR পদ্ধতি চালু আছে এবং নির্দিষ্ট ভোটসীমা (threshold) নিশ্চিত করে ছোট দলগুলোর অতিরিক্ত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি সীমা ৩–৫ শতাংশের মধ্যে নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা ভারসাম্য বজায় রাখবে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করবে।
এই রূপান্তর সাধনের জন্য একটি ধাপে ধাপে রোডম্যাপ প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই শহর ও পৌরসভা পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে PR পদ্ধতি প্রয়োগ, নারী সংরক্ষিত আসনে পাইলট প্রকল্প চালু, এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এরপর ২০২৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদের একটি অংশে (২০–৩০ শতাংশ) PR ভিত্তিক আসন অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে, এই প্রক্রিয়াকে বিস্তৃত করে একটি পূর্ণাঙ্গ মিক্সড-মেম্বার প্রপোরশনাল সিস্টেম গঠনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এ ধরনের একটি সংস্কার বাস্তবায়িত হলে প্রতিটি ভোট অর্থবহ হয়ে উঠবে। জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাবে, নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থান সহজ হবে এবং সংসদ হবে আরও কার্যকর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এতে করে বাংলাদেশ শুধু অভ্যন্তরীণভাবে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একটি আধুনিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পারবে।
এই প্রস্তাব একদিকে যেমন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, তেমনি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে—যেখানে সহাবস্থান, অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব হবে নির্বাচন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ২০২৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই সেই সাহসী ও ভবিষ্যতমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
সলিসিটর ও প্রাক্তন মেয়র, টাওয়ার হামলেটস