শফিকুল হক : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যা বিদ্যমান, তা অনেকাংশেই একটি বিজয়-নির্ভর, সংখ্যালঘু-অবজ্ঞাকর এবং অসম নির্বাচন ব্যবস্থা, যা বাস্তবে জনগণের ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ। যে পদ্ধতিতে ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি দল সংসদের ৮০ শতাংশ আসন দখল করতে পারে, সেই পদ্ধতি গণতন্ত্রের প্রকৃত আত্মা—“জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা”—এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সংকট থেকে উত্তরণের একটি বাস্তবসম্মত, ন্যায়সঙ্গত এবং টেকসই পথ হল PR (Proportional Representation) বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা। এটি কেবল একটি বিকল্প নয়—এটি একটি দাবি।
অনুপাতিক নির্বাচন: গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি PR ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এর ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণমূলক চরিত্র। এখানে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে, প্রতিটি নাগরিকের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। কোনো একটি রাজনৈতিক মত বা দলের একচেটিয়া আধিপত্য এখানে অবাস্তব। এটি এমন একটি পদ্ধতি যা নিশ্চিত করে যে— “সংসদ জনগণের ক্ষুদ্রতম কণ্ঠস্বরকেও প্রতিফলিত করবে”।
FPTP ব্যবস্থায় এমন বহুবার দেখা গেছে, যেখানে একটি দল ৫৫% ভোট পেয়ে প্রায় ৯০% আসন পায়, আর ৪৫% ভোটপ্রাপ্ত বিরোধী দল সংসদে ১০% এর নিচে উপস্থিত থাকে। এর নাম গণতন্ত্র হতে পারে না।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় PR পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমানে আমাদের দেশে:
সংসদে কার্যত একদলীয় নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান
বিরোধী দল নিস্ক্রিয় বা অনুপস্থিত
জনগণের আস্থা নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে যাচ্ছে
সংখ্যালঘু, নারী ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রবেশ বাধাগ্রস্ত
এই সংকটের সমাধান PR ব্যবস্থা। কারণ এতে:
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রাপ্য অনুযায়ী আসন বরাদ্দ হয়
প্রান্তিক মত, নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও সংখ্যালঘু কণ্ঠস্বর সুযোগ পায়
একক আধিপত্য কমে, সমঝোতাভিত্তিক রাজনীতি বিকশিত হয়
জনগণ তার ভোটের প্রকৃত মূল্য পায়—কোনও ‘নষ্ট ভোট’ নেই
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: PR ব্যবস্থা সফলতা অর্জন করেছে
বিশ্বব্যাপী, উন্নত ও প্রগতিশীল গণতন্ত্রগুলো PR ব্যবস্থাকে বেছে নিয়েছে:
জার্মানি: দ্বৈত PR পদ্ধতির মাধ্যমে স্থিতিশীল ও কার্যকর কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠা
নেদারল্যান্ডস: ছোট দল ও ভিন্নমতকে সুযোগ দিয়ে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ
নিউজিল্যান্ড: FPTP থেকে PR-এ রূপান্তরের পর ভোটারদের সন্তুষ্টি ও প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে
PR বাস্তবায়ন: বাংলাদেশে সম্ভাব্য কাঠামো
বাংলাদেশে PR ব্যবস্থা চালু করার জন্য নিম্নোক্ত কাঠামো বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে:
মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতি (Mixed Member Proportional – MMP)
৫০% আসন সরাসরি (FPTP)
৫০% আসন দলীয় ভোটের অনুপাতে (PR)
একটি স্বাধীন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে PR চালু
প্রথমে একটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে স্থানীয় সরকার বা সিটি নির্বাচনে PR চালুর মাধ্যমে বাস্তবায়ন শুরু
PR পদ্ধতির বিরুদ্ধে যুক্তিগুলোর প্রতিভবন :বিভিন্ন সময়ে PR-এর বিরুদ্ধে বলা হয়—”এতে কোয়ালিশন সরকার হয়, অস্থিরতা বাড়ে”। বাস্তবে, কোয়ালিশন সরকার মানেই অস্থিতিশীল নয়। এটি মানে সহযোগিতামূলক শাসন, যেখানে একক কর্তৃত্ব নয় বরং আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘অস্থিরতা’ এসেছে একক আধিপত্য, নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন, এবং বিরোধীদলহীন সংসদ থেকে—not from pluralism.
PR মানে জনগণের প্রকৃত বিজয় : আজ যখন গণতন্ত্রের নামে বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ হচ্ছে, নির্বাচন শুধু ‘পদ্ধতি’ হয়ে উঠেছে—‘উৎসব’ বা ‘আস্থা’ নয়, তখন PR ব্যবস্থা প্রয়োজন:
সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বের জন্য
সংসদকে জনগণের প্রতিচ্ছবি করার জন্য
ভোটের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য
গণতন্ত্রকে কেবল নামমাত্র নয়, বাস্তবিক অর্থে কার্যকর করার জন্য
উপসংহার: সময় এসেছে পরিবর্তনের অনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি এখন কেবল একটি ‘অপশন’ নয়—এটি একটি দাবি, একটি দায়িত্ব, একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
যদি আমরা চাই একটি শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল ও প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র—
তাহলে PR ব্যবস্থা অপরিহার্য। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম যেন এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে, যেখানে প্রতিটি কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব আছে, প্রতিটি ভোটের মূল্য আছে, এবং প্রতিটি নাগরিক জানে—তাদের অংশগ্রহণে প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব।