শাহাবুদ্দিন শুভ : ৭ আগস্ট ২০২৪—এই দিনটিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হলো “Bideshi (বিদেশি)” শিরোনামের একটি গান। প্রকাশের আগেই গানটির কিছু লাইন সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষ করে Facebook-এ, ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। গানের মূল লাইনগুলো অনেক প্রবাসীর হৃদয়ের অনুভূতি তুলে ধরে—
“না হইতে পারলাম আমি বাঙালি
দেশে গেলে দেশের মাইন্সে কয় আমি বিদেশি
দেশের বাড়ি সিলেট আমার, লন্ডন শহর বাস করি”
প্রবাসীদের আবেগময় অভিজ্ঞতা নিয়ে গড়া এই গানটি প্রকাশের পর ইউটিউব এবং অন্যান্য মাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রায় সাড়ে চার মিনিটের এই গানের ভিডিওতে ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের সময় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার দৃশ্যও রাখা হয়েছে—যা নিঃসন্দেহে দেশপ্রেম ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
কিন্তু এই প্রশংসার মাঝেই একটি অস্বস্তিকর এবং আইনগতভাবে গুরুতর বিষয় চোখে পড়ে—গানের দৃশ্যে প্রদর্শিত পতাকাটি ছেঁড়া অবস্থায় ছিল। এই ছেঁড়া জাতীয় পতাকা শুধু নান্দনিকতার বিপরীতে নয়, বরং বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
আইন যা বলছে : বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২ খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে—
“জাতীয় পতাকা অবমাননা, বিকৃতি, অপব্যবহার বা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করলে তা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।”
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২৩(ক) ধারা অনুযায়ী—
- জাতীয় প্রতীক বা পতাকার অবমাননার জন্য কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
- ইচ্ছাকৃত অবমাননার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।
- অনিচ্ছাকৃত হলেও জরিমানা বা স্বল্পমেয়াদি কারাদণ্ড হতে পারে।
এখানে “অবমাননা”র সংজ্ঞা শুধু ইচ্ছাকৃত অপমান নয়, বরং যে কোনোভাবে পতাকার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করাকেও অন্তর্ভুক্ত করে—যেমন ছেঁড়া, ময়লা বা বিধি-বহির্ভূতভাবে প্রদর্শন করা।
কেন এটি গুরুতর অপরাধ :
জাতীয় পতাকা কেবল একটি কাপড়ের টুকরা নয়—এটি একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, ত্যাগ ও মর্যাদার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পরিচয়—সবকিছুই এর সাথে জড়িয়ে আছে।
ছেঁড়া পতাকা প্রদর্শন মানে জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা। এবং যখন এটি গণমাধ্যমে, বিশেষ করে একটি জনপ্রিয় গানে প্রকাশিত হয়, তখন এর প্রভাব আরও বিস্তৃত হয়। এমন প্রদর্শন দর্শকদের কাছে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দিতে পারে—যেন পতাকার প্রতি যত্ন বা মর্যাদার প্রয়োজন নেই।
জাতীয় পতাকা বিধিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে—
- পতাকা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা অবিলম্বে অবসর নিতে হবে।
- বিধি অনুযায়ী পতাকাটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ বা বিনষ্ট করতে হবে।
- চলচ্চিত্র, নাটক, বিজ্ঞাপন বা ভিডিওতে পতাকা ব্যবহারের সময় আইনগত বিধি মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
এটি কি ইচ্ছাকৃত, নাকি অনিচ্ছাকৃত ভুল?
প্রযোজনা দলের পক্ষে হয়তো বলা যেতে পারে—এটি তাদের অজান্তে ঘটেছে, হয়তো লোকেশন বা সেটে পতাকাটি এমন ছিল, যা নজরে আসেনি। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে—যখন একটি গানের প্রতিটি দৃশ্য সাবধানে সাজানো হয়, তখন জাতীয় পতাকার মতো সংবেদনশীল প্রতীকের অবস্থা কি নজরে আসেনি?
যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন দৃশ্য রাখা হয়ে থাকে, তাহলে এটি আরও গুরুতর অপরাধ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত হবে বিষয়টি তদন্ত করা।
সচেতনতার ঘাটতি
এই ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে—শিল্পী, প্রযোজক এবং কনটেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে জাতীয় পতাকা সংক্রান্ত আইন ও বিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। প্রবাসে বসে দেশপ্রেমের গান বানানো প্রশংসনীয়, কিন্তু যদি সেই প্রযোজনায় আইন ভঙ্গ হয়, তাহলে উদ্দেশ্য যত ভালোই হোক, তা বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দেয়।
এক্ষেত্রে তিনটি দিক জরুরি—
১। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: গণমাধ্যম ও বিনোদন জগতে যারা কাজ করেন, তাদের জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের নিয়ম শেখানো।
২। গাইডলাইন তৈরি: সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মিডিয়া প্রোডাকশনে পতাকা ব্যবহারের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশিকা প্রকাশ করা।
৩। আইন প্রয়োগ: আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত এমন ঘটনায় নজর দেওয়া এবং প্রয়োজন হলে সতর্কতা বা শাস্তি প্রদান করা।
“বিদেশি” গানটির শিল্পীরা প্রবাসী বাঙালির আবেগ ও অভিজ্ঞতা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, কিন্তু ছেঁড়া জাতীয় পতাকা প্রদর্শনের ঘটনা সেই বার্তায় একটি বড় দাগ টেনেছে।
জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা কেবল সরকারের কাজ নয়—এটি প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব, প্রবাসী হোক বা স্বদেশে। দেশপ্রেম কেবল কথায় নয়, তা প্রকাশ পায় কাজের মাধ্যমে, প্রতীকের প্রতি সম্মানে।
আমাদের মনে রাখতে হবে—পতাকা শুধু বাতাসে ওড়ানো একটি কাপড় নয়; এটি একটি জাতির আত্মা, ইতিহাস ও গর্বের প্রতীক। তাই এর প্রতি অবহেলা মানে নিজের প্রতি অবহেলা।
সম্পাদক : অভিবাসন
ahmedshuvo@gmail.com