শফিকুল হক : বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে—যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়—তালিকা থেকে বাইরে আওয়ামী লীগ, যারা টানা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিল। আর এই অনুপস্থিতিতে জমে উঠছে এক অপ্রত্যাশিত দ্বিমুখী লড়াই—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বনাম জামায়াতে ইসলামী।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, স্বচ্ছতার অভাব ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। সেই আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি হিসেবে জাতীয় ঐকমত্যে গঠিত হয় একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আনা হয় আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ও গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিত্ব—ড. ইউনুসকে। জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহ এখন তুঙ্গে, বিশেষ করে তরুণ ভোটাররা এই নির্বাচনকে দেখছেন পরিবর্তনের একটি সুযোগ হিসেবে।
এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন। দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের প্রায় সব বড় বিশ্ববিদ্যালয়েই তারা নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতে ইসলামী সরাসরি সরকার গঠনের লক্ষ্যে এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমান জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তায় অতীতের সব ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে এবং অনেকেই এটিকে একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখছেন। বিশ্লেষকদের মতে, যদি কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকে এবং দলটি বাস্তবে গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে, তাহলে জামায়াত একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু করতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপির জন্য এ নির্বাচন যেমন একটি সুযোগ, তেমনই একটি চ্যালেঞ্জও। দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদলে থাকা বিএনপি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইলেও, মাঠে তারা এখন জামায়াতের মতো এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি। বিশেষ করে যখন ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে প্রত্যাশিত সাফল্য দেখাতে পারেনি, তখন জামায়াতের ছাত্রভিত্তিক উত্থান বিএনপির জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হলেও, বাস্তব মাঠপর্যায়ে সংগঠনের দুর্বলতা এবং তরুণ সমাজের সঙ্গে সংযোগের ঘাটতি এখন বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
এদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে ন্যাশনালিস্ট ছাত্র পরিষদ (NCP) কে ঘিরে। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী এই সংগঠনটি তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। তারা একটি নিবন্ধিত দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীক চেয়ে আবেদন করলেও, তা গ্রহণ করা হয়নি এবং দলটি নির্বাচনী মাঠ থেকে কার্যত বাদ পড়ে যায়। এটি ভোটারদের একটি বড় অংশের হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে তরুণরা মনে করছেন, নতুন প্রজন্মের রাজনীতি করার অধিকার এখানে উপেক্ষিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে প্রতীক সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে NCP-এর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আপসরফার পথ খোলা রাখা উচিত—যাতে দলটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং কোনো গ্রহণযোগ্য প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারে। এটি শুধু একটি দলের জন্য নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিপ্লবের পর জনমনে ব্যাপক প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছিল যে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তারা ছিল সেই পরিবর্তনের প্রধান বাহক, যারা বহু বছর ধরে বঞ্চিত ও অবহেলিত তরুণ সমাজের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনী পরিস্থিতি ও ছাত্ররাজনীতির বাস্তবতা এই স্বপ্নকে কিছুটা বিষন্ন করেছে। যদিও জামায়াতে ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে বিএনপির ছাত্রদল প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। আর ন্যাশনালিস্ট ছাত্র পরিষদ (NCP) নির্বাচন থেকে বহিষ্কার হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও বিকল্প রাজনীতির স্বপ্নে এক ধরনের অবরোধ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায়, ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য শিক্ষার্থীদের স্থান সুনিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তরুণ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর অন্তর্ভুক্তি ও সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।
এমন এক পটভূমিতে জাতি এখন তাকিয়ে রয়েছে আসন্ন নির্বাচনের দিকে। নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বললেও, জনগণ এখন পর্যন্ত সতর্ক আশাবাদ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এই প্রক্রিয়া, কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একটি শক্তিশালী শাসক দল অনুপস্থিত, একটি নতুন নেতৃত্বাধীন নিরপেক্ষ সরকার, এবং দুই ঐতিহ্যবাহী বিরোধী দলের মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সব মিলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হতে যাচ্ছে দেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ নির্বাচন। এই ভোট হবে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরীক্ষা। কে সরকার গঠন করবে, তার থেকেও বড় প্রশ্ন—জনগণের ভোটাধিকার, অংশগ্রহণ, এবং ভবিষ্যতের জন্য তারা কী বার্তা দিতে চায়। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু একটি সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়, বরং একটি সম্ভাব্য নতুন গণতান্ত্রিক সূচনার দ্বারও।
শফিকুল হক
অ্যাডভোকেট ও সলিসিটার
সাবেক মেয়র, টাওয়ার হ্যামলেট
নিজস্ব সংবাদ : 




















