জামিউল আহমেদ :: কথা কম কাজ বেশি। পর্যটনের মূল মন্ত্র এটি। অথচ তিপান্ন বছরেও আমাদের কথা শেষ হয়নি। এখনো সর্বসাকুল্যে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, পর্যটন বয়ান আর গাল ভরা ফাঁপা বুলি ছাড়া কিইবা আছে। ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছেন “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” এর একজন ইউনিট ম্যানেজার। দিনভর তাদেরকে নিয়ে হয়ে গেলো সাক্সেসফুল ওয়ার্কশপ। খাস বয়ানে ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব আর আম বয়ানে ছিলেন পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান এবং ডিরেক্টর, মারহাবা। এদিকে সিলেটে পর্যটন নিয়ে সেমিনার আয়োজন করেছেন আরেক পর্যটন প্রেমী সিলেটের মান্যবর জেলা প্রশাসক। অথচ দাওয়াত দেননি কোন পর্যটন সমিতিকে। ওরা সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বাঁধিয়েছে তুলকালাম কাণ্ড। তাহলে কি বাকী থাকবে “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড”? না তারাও কম যায়নি, তড়িগড়ি একখান ওয়ার্কশপ ইন্তেজাম করেছে। এবার পর্যটনকে সবুজ করে ফেলবে, তাই বিষয় “সবুজ পর্যটন”। ব্যাপারটা কি? কোন কাজ না থাকলে যাই হয়, “নাই কাজ তো খই ভাজ”। এভাবেই চলছে হবু চন্দ্রের দেশে গবু চন্দ্রদের কাজকারবার।
দেশ স্বাধীন হলো আসলো প্রেসিডেন্ট এর ফরমান। “পাকিস্তান ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন” (পিটিডিসি) এর স্থলে হলো “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” (বাপক)। কার্যক্রম শুরু করতে লাগবে আমলা। পদে আসীন হলেন একজন চেয়ারম্যান এবং কয়েকজন পরিচালক। তখন থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যটনের কোন মন্ত্রণালয় না থাকায় বাপক অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে মোটামুটি ভালোই চলছিল। পরে মন্ত্রণালয় সৃষ্টির সাথে সাথে এক ঝাঁক আমলা অবতীর্ণ হলেন। আর যায় কই এবার পর্যটনের পুরোটাই তাদের দখলে চলে গেলো। এতে পর্যটন তার নিজস্বতা হারালো এবং নিজের নিয়মে না চলে আমলাদের নিয়মে চলতে বাধ্য হলো। ফলশ্রুতিতে একদিকে পর্যটন শিকলে বাঁধা পড়লো এবং অন্যদিকে আমলাতন্ত্র প্রতিপালন আর সরকারগুলোর গুণকীর্তন স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
তাহলে আমলাতন্ত্র কি খারাপ কিছু? না, অবশ্যই না। ভ্লাদিমির লেনিনের একটা উক্তি আছে, “যেখানে শরীর সেখানে রক্ত, যেখানে রাষ্ট্র সেখানে আমলাতন্ত্র”। অর্থাৎ রাষ্ট্র চালানোর জন্য আমলাতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। যেজন্য আমলাতন্ত্রের তাত্বিক জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আমলাতন্ত্রের জন্য দক্ষতা, শৃঙ্খলা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতের উপর জোর দিয়েছিলেন। কেন না সরকার তার নীতি নির্ধারণ দ্বারা সে কি করতে চায় তা বলে দেবে। আর তা বাস্তবায়ন করবে এই আমলারাই বেসরকারি খাতকে সাথে নিয়ে। এক্ষেত্রে সরকার তার প্রতিনিধি অর্থাৎ একজন মন্ত্রীর মাধ্যমে প্রশাসন তথা আমলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। যাতে তারা কোন ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই সরকার ঘোষিত কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারেন। এজন্য বৃটিশ শাসনতন্ত্রে একটি কথা আছে, “মিনিষ্টার্স আর দ্য শিল্ড অব দ্য ব্যুরোক্রেটস”।
কিন্তু আমাদের সরকারগুলোর রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা থাকেন যারপর নাই দুর্বল। এতে তাদের আন্তরিকতা ও একাগ্রতার অভাব এবং বিশেষ করে অনভিজ্ঞতা প্রসূত দুর্বলতার পুরো সুযোগটা নেন আমলারা। তারা হয়ে উঠেন দুর্বার-দুর্দমনীয়। তোয়াক্কা করেন না জবাবদিহিতা আর স্বচ্ছতার। তাই মন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণের লাগাম উলটো চলে যায় আমলাদের হাতে। এতে মন্ত্রী হয়ে যান ঠুঁটো জগন্নাথ। আমলারা যা শুনান তাই শুনেন, যা করতে বলেন তাই করেন। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের অবস্থা আরো খারাপ। এদের নিজেদের অনৈক্য আর স্যার স্যার বলে তেলবাজি করা এবং মতলব হাসিলের জন্য খয়ের খাঁ সাজার সংস্কৃতির পুরো সুযোগটাই নেন আবার ঐ আমলারা।
এতে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে পর্যটনের জন্য ভালো কোন সিদ্ধান্ত তথা মৌলিক বিষয়ে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন প্রায় হয়েই উঠছেনা। তারপরও যা কিছু সিদ্ধান্ত আসে তা হয়তো পর্যটনের নিয়মের ও স্বার্থের অনুকুলে থাকেনা। নয়তো শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়নই হয় না। বলতে গেলে বলা যায় প্রায় সবকিছুই হয়ে যায় স্রেফ লোক দেখানো, পর্যটনের মৌলিক কিছু নয়। তাতেও সুচতুর আমলারা নিজেদের সামনে রেখে সব দেখান বটে কিন্তু দায়ভার চাপান সরকার আর বেসরকারি খাতের ঘাড়ে। অর্থাৎ গাছের ডাল কাটার সিদ্ধান্তটা ভালো-মন্দ যাই হোক এটি কাটার সময়ে সুচতুর আমলারা থাকেন গাছে আর সাথে থাকা গবেট বেসরকারি খাত এবং সরকারকে রাখেন ডালে। এতেকরে ডালটা কাটার পর যখন নীচে পড়ে যায় তখন ভালো কিছু হলে সেই সুনাম একান্ত আমলাদের। কিন্তু যদি মন্দ কিছু হয়ে যায় তখন দায়ভার এবং বদনাম পুরোটাই বর্তায় নির্বোধ সরকার আর গবেট বেসরকারি খাতের উপরে। তার সারমর্ম হলো, আমলারা সব সময় থাকেন বৃক্ষে এবং নিরাপদে।
এতে লোক দেখানোর মত কিছু কাজ হলেও পর্যটনের মৌলিক কাজ যেগুলো না হলে শিল্পটির উন্নয়ন হবেনা এমন কি বাঁচিয়ে রাখাও মুশকিল হবে সেগুলোর কোন সুরাহা হয়না। যেমন কার্যকর প্রশাসন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, গবেষণা, অর্থায়ন, আইন প্রণয়ন, সম্পদ চিহ্নিতকরণ, সেবা চিহ্নিতকরণ, সেবার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ (কিউটিএস), শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিতকরণ, বিনিয়োগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ, পর্যটন পণ্য উন্নয়ন, বাজার নিশ্চিতকরণ, পণ্য বিপণন, হিসাব ও পরিসংখ্যান (টিএসএ) সংরক্ষণ, জাতীয় পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার (এনটিডিবি) চালুকরণ, মানসম্পন্ন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ, টেকসই ও দায়িত্বশীল পর্যটন চর্চা নিশ্চিতকরণ ইতাদি সবকিছুই হয়তো শুরুই হয়নি নয়তো আলোর মুখ দেখেনি।
অথচ এগুলো না হলে পর্যটনের জন্য কিছু করা বা উন্নয়ন ভাবনা ভাবনাই থেকে যাবে এবং যাচ্ছে। উপরন্তু আমাদের পর্যটন শিল্পের অমিত সম্ভাবনা থাকার পরও সে পিছিয়ে পড়ে আছে। কাজে লাগানো হচ্ছেনা আল্লাহর রহমত এবং প্রকৃতির দান পর্যটন সম্পদ এবং মানব সম্পদ কোনটিকেই। বলা হচ্ছে এবং সরকারও তার সর্বশেষ নীতিমালাতেই স্বীকার করেছে বাংলাদেশে পর্যটন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তাহলে পর্যটনের উন্নতি দূরে থাক এতদিনের এত ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার কার বা কাদের? অবশ্যই সরকার, প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্র এবং বেসরকারি খাত সবার। তবে, সবচেয়ে বেশি দায়ভার এই আমলাতন্ত্রের যেহেতু এসব কাজ অন্যরা চাইলেই করতে পারেনা; পারে সহযোগীতা করতে। কিন্তু আমলাতন্ত্র চাইলে এবং সদিচ্ছা থাকলে এসব কাজ করা তাদের জন্য কোন ব্যাপারই নয়। অথচ তারা তা করবেনা নিজেদের স্বার্থে, এতে পর্যটনের ক্ষতি হয় হোক।
তাহলে দেখা যাচ্ছে এত বছরে ক্ষতি এবং সমূহ ক্ষতি শুধু অভাগা পর্যটনেরই আর লাভ কমবেশি বাকী সবার। যেমন সরকারগুলো মন্ত্রণালয়ে তাদের মন্ত্রী বসিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নিয়েছে বটে কিন্তু সার্বিক দায়ভাগ এড়াতে পারেনি। তেমনি বেসরকারি খাতের কেউ কেউ কমবেশ কিছুটা সুযোগসুবিধা পেয়েছে বটে। তবে তাও আমলাদের দয়ায় এবং ইচ্ছায়। কিন্তু বঞ্চিত হয়ে আছে পর্যটন শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট বাকী সবাই এবং সবকিছুতেই। অথচ আমলাতন্ত্রের কোনই ক্ষতি নেই শুধু লাভ আর লাভ। পর্যটনের শুরু থেকে একে একে বাপক, মন্ত্রণালয়, বিটিবি ইত্যাদিতে কত কত আমলার চাকুরীর সুযোগ মিলেছে। আবার বাপক এবং বিটিবি’র বোর্ড রয়েছে; সেখানেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে প্রায় সবাই থাকেন ঐ আমলারাই। এতে একচ্ছত্র আধিপত্য ঐ আমলাদেরই। কেন না ঐসব বোর্ডে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ থাকে একেবারেই নামে মাত্র। তাও আবার তেল মর্দন করা।
বিশ্বের বহু দেশে তাদের আছে শুধু একটি পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনে প্রয়োজনীয় কিছু বিভাগ। এই দিয়েই তাদের পর্যটন শিল্প ব্যাপক সফলতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার কোন কোন দেশে প্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ অথবা বোর্ড রাখা হয়েছে। যেগুলো লক্ষ কোটি বিদেশি পর্যটকও দেশে নিয়ে আসছে আবার পর্যটনের উত্তরোত্তর উন্নতিও সাধন করছে। অর্থাৎ আমাদের মত এত রাশভারি প্রশাসন নিয়ে কেউ চলছেনা আর চললেও তার থেকে বহুগুণ ফায়দা আদায় করে নিচ্ছে। আমরাই শুধু প্রশাসনে অহেতুক গর্ত সৃষ্টি করে এগুলো আমলাদের দিয়ে ভরাট করি। অবশ্য এই কাজটুকু আমলারা খুব সুচতুরভাবে হবুচন্দ্র সরকারগুলোর ঘাড়ে বন্দুক রেখে পাখী শিকারের মত সবই করে করে ফেলে। এমন কি প্রয়োজনে তারা বুড়ো আঙ্গুল প্রদর্শনেও কার্পন্য করেনা।
এসব নিয়ে হয়তো ভুরি ভুরি ঘটনা উল্লেখ করা যাবে যেগুলোকে তারা তাদের স্বার্থের বাইরে যেতে দেয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আর না পারলেও অন্তত দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে তথা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফেলে এমনকি অসহযোগীতা কিংবা চাপ সৃষ্টি করে হলেও তাদের ইচ্ছা ও স্বার্থের বাইরে যেতে দেয়নি। এখানে এই পরিসরে এতসব বিস্তারিত নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তবে, উদাহরণ হিসেবে হলেও অন্তত একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। এসব ঝক্কি-ঝামেলা এড়ানোসহ রাশভারি প্রশাসনের স্থলে সীমিত ও কার্যকর প্রশাসন এবং আইন প্রণয়নের অহেতুক বাঁধা ডিঙ্গানোর জন্য বহুদিনের দাবী ছিল গোটা পর্যটন শিল্পের জন্য একটি একক পর্যটন আইনের। কিন্তু তা এই আমলাদের অসহযোগীতার জন্য সম্ভব হচ্ছিলনা। শেষ পর্যন্ত সুযোগ আসলো গত তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। গঠিত হলো একটি শক্তিশালী কমিটি। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি নিজেও ছিলাম এই কমিটিতে।
গঠিত ঐ কমিটি আমারই অফিসে বসে এবং কয়েক মাস অনেক পরিশ্রম করে সরকারি বেসরকারি খাত সবার মতামতের ভিত্তিতে একক পর্যটন আইনের জন্য একটি খসড়া তৈরী করলো। এবার সবাই একাট্টা হয়ে এটি দ্রুত আইনে পরিণত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করলেন। এরই প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা একের পর এক ঘোষণা দিয়ে জানালেন, “খুব দ্রুত একক পর্যটন আইনের অধ্যাদেশ হতে যাচ্ছে”। এরই মধ্যে একদিন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সচিব মহোদয় আমাকে একান্তে নিয়ে জানালেন যে, আইনটি শেষ পর্যন্ত হবেনা। তবে, কেন হবেনা তা তিনি জানাতে অস্বীকার করলেন এবং বিষয়টি আমাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে অনুরোধ জানালেন। তাহলে আমাকেইবা কেনো জানালেন এই জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বললেন, আপনি বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস এবং সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমও করছেন। তাই এমন এক খবরের জন্য যাতে আপনার আগাম প্রস্তুতি থাকে এবং নিজেকে সামলেও নিতে পারেন। ব্যস, এই পর্যন্তই।
তবে, সর্বশেষ ঠিকই একক পর্যটন আইনটি আর আলোর মুখ দেখলোনা। এদিকে উপদেষ্টা মহোদয় তার বিদায়ের প্রাক্কালে আমাদের ডেকে নিয়ে এবং প্রায় চোখে জল নিয়ে অনুরোধ রেখে গেলেন যেনো চেষ্টাটা অন্তত অব্যাহত রাখা হয়। কিন্তু আমলাদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কি কিছু করা সম্ভব? না, সম্ভব নয় এজন্য যে তারা তাদের ইচ্ছা বলি আর স্বার্থ বলি এর বাইরে একচুলও যাবেননা। অথচ একক পর্যটন আইনটি হয়ে গেলে একদিকে আমলা প্রতিপালন সীমিত এবং স্তিমিত হয়ে যেতো আবার অন্যদিকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বেড়ে যেতো। তাছাড়াও ভবিষ্যতে এটিকে সহজে পরিবর্তন করা যেতোনা। তাই তারা এটিকে সরাসরি ঠেকিয়ে দিয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার গদিতে বসার সাথে সাথে প্রশাসনকে আরো সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড” সৃষ্টি করে ফেললেন। এতে একদিকে হাবলু গণতান্ত্রিক সরকারেরও কিছু করার থাকলোনা এবং অন্যদিকে আমলাদেরও আরো বেশি বেশি পদে আসীন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেলো।
এতে কাজের কাজ যা হলো বয়ষ্ক পর্যটন করপোরেশনের ক্ষমতাকে খর্ব করে তা এনে এই শিশু পর্যটন বোর্ডের কোলে বসিয়ে দেয়া হলো। তাতে আমলাদের লাভ হলো বটে কিন্তু পর্যটনের সরাসরি ক্ষতি হলো। কারণ নতুন বোর্ডের নেই লোকবল, অভিজ্ঞতা, অর্থ, সহায়-সম্পদ এবং স্বাধীনতা কিছুই। ফলে ট্যুরিজম বোর্ডকে অধিক ক্ষমতা দিয়ে দিলেও তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছিলনা। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমি এই দুই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্ম পরিধির আইনগত বিষয়টি এবং বাস্তবতা সামনে নিয়ে আসলাম। তারপরও যখন এর কোন সুরাহা হচ্ছিলনা তখন এক সময় সুযোগ বুঝে এক ক্ষমতাধর ঝানু আমলা ফের দাবার গুটির চাল দিয়ে দিলেন। বলা হলো, আবার বাপকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সংশোধিত আইন প্রণয়ন করা হবে। এই বক্তব্যকে বাজারে ছেড়ে দিয়ে সামনে মুলা ঝুলিয়ে সুচতুর সেই আমলা চাণক্য কর্ম শুরু করলেন। তিনি দেখলেন পদাধিকার বলে ট্যুরিজম বোর্ডের চেয়ারম্যানতো আছেনই এখন যদি পর্যটন করপোরেশনেও একটি বোর্ড করা যায় তাহলে সেখানেও পদাধিকার বলে তিনি বা অন্য কোন আমলা প্রেসিডেন্ট এর চেয়ার অলঙ্কৃত করতে পারবেন। এর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু আমলার জন্য পদ-পদায়ন নিশ্চিত করা যাবে।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। কাউকে কিছু না জানিয়েই অনেকটা চুপি চুপি মহান জাতীয় সংসদে হ্যাঁ জয়যুক্ত করানোর মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রের জয় হলো। অথচ নতুন এই সংশোধিত আইনে পর্যটনের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন কিছু না থাকলেও আমলাদের জন্য ঠিকই জমিনটাকে আরো প্রশস্ত করা হয়েছে। যেমন আইনটির ৭ম অনুচ্ছেদের ৮ ধারায় একটি বোর্ড গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে একজন প্রেসিডেন্টসহ মোট ১১ জন পরিচালক থাকবেন। তার মধ্যে দুইজন মাত্র বেসরকারি খাতের যারা আবার সরকার তথা আমালাদেরই পছন্দে সেখানে প্রবেশাধিকার পাবেন। আবার অনুচ্ছেদ ৯ এ বলা হয়েছে বাপকের জন্য থাকবেন একজন চেয়ারম্যান এবং আরো অনির্ধারিত সংখ্যক পরিচালক যারা সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। তার অর্থ দাঁড়ালো সংশোধিত আইনটিই করা হয়েছে পর্যটনের স্বার্থে নয় বরং স্রেফ আমলাদের পদ- পদবী এবং অন্তর্ভুক্তিকে নিশ্চিতভাবে আরো বিস্তৃত করা জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো একক পর্যটন আইনকে ঠেকাতে গিয়ে মন্ত্রণালয়েয় অতিরিক্ত পর্যটন বোর্ড সৃষ্ট আমলা, বোর্ডের গভর্নিং বডির আমলা, বাপকের আমলা এবং তদীয় বোর্ড সৃষ্ট আমলার সংখ্যা তথা সাইজ বিবেচনায় কিংবা অনুপাতে পর্যটনের কি কোন ফায়দা হয়েছে? অবশ্য অবশ্যই না। কারণ, পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাদ দিলেও অন্তত মৌলিক যে কাজগুলো করা দরকার সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। উপরন্তু আমলাদের এই যে বিরাট সংখ্যা একের পর এক বৃদ্ধি করা হয়েছে বা হচ্ছে তাদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, লোক দেখানো কাজ এবং তাদের ইচ্ছা মাফিক পর্যটন চালানোর জন্য অতিরিক্ত জনবলের যে লটবহর এসব মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে যে অর্থের অপচয় হয়েছে তার বিপরীতে যে প্রাপ্তি তা থেকে আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটনের উন্নয়তো দূরে থাক উপরন্তু সে এখন এক শ্বেতহস্তীতে পরিণত হতে চলেছে।
অথচ প্রাপ্তি হচ্ছে, এ পর্যন্ত হবুচন্ত্র সরকারগুলোর অন্তত পাঁচজন মন্ত্রী জেলে গিয়েছেন। মাশাল্লাহ, তার সাথে মন্ত্রণালয়ের আমলাদের মধ্যে এই প্রথম সেই পদ সৃষ্টিকারী নাটের গুরু সচিবও সাথি হয়ে কারাবরণ করেছেন। অন্যদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিশেষ করে করোনা তাণ্ডবের পর ফতুর হয়েছেন এবং হাজার হাজার পর্যটন কর্মী কোন ফাস্ট এইড ছাড়াই মাঠ ছেড়েছেন। অথচ বাদবাকী আমলাদের কেশাগ্রও কেউ ছুঁতে পারেনি। উপরন্তু তারা তেলবাজ-মতলববাজদের সাথে নিয়ে নিশ্চিন্তে মাঠ দাপাচ্ছেন কিংবা সুপার লীগে খেলার সুযোগ নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিন লোকদেখানো কাজ হিসেবে এখানে সেখানে পর্যটন মাহফিলে গিয়ে আম বয়ান নাহয় খাস বয়ান দিচ্ছেন এবং সাথে বেকুফদের প্রশংসা ও হাততালি পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আমলাদের এই বিস্তৃত বেড়াজাল ভেদ না করা গেলে অতি সম্ভাবনাময় অথচ হতভাগ্য পর্যটনকে মোটাতাজা করাতো দূরে থাক খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল হবে।
অবশ্য একটা সুযোগ এসেছিলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার চিকিৎসার সুযোগ নেয়ার। কেন না পর্যটনের যে সমস্যা তা এত বছরে একেবারে ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। কিন্ত হায় বিধিবাম; অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। এই সরকার খ্যাতিতে আন্তর্জাতিক আর চিন্তা-চেতনায় উচ্চ মার্গের। তাঁরা তাদের সংস্কারের পোঁটলা থেকে শিক্ষার সাথে পর্যটনকেও সরিয়ে রেখেছে। অবশ্য লিখিতভাবে বিস্তারিত জানিয়েছি তারপরও সরকার অনড়-অটল। অথচ একমাত্র এই শিক্ষাই রক্ষা করতে পারে জাতিকে আর পর্যটনই রক্ষা করতে পারে জাতির অর্থনীতিকে। যাহোক, সুচিকিৎসার মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী ব্যধি থেকে পর্যটন শিল্পকে বাঁচিয়ে উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতেই হবে। এজন্য আজ হোক আর কাল হোক আমলাতন্ত্রের এই দখলদারিত্ব ও দৌরাত্ম্য সমূলে উৎপাটন করে পর্যটনকে আবার ঢেলে সাজাতে হবে। নতুবা কোনদিনই পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবেনা হবে আমলাতন্ত্রের প্রতিপালন।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)।