অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী ওয়াক্কাস :: সিলেট শব্দটার সাথে আবেগ ভালোবাসা ভালোলাগার অন্যরকম অনুভূতি জড়িত।এ যেন মায়ার বন্ধন! জনপদের মানুষজনের আত্মিক সম্পর্ক ঈর্ষা করার মত। সারাবিশ্বের নানা প্রান্তে এখনকার নাগরিকরা চষে বেড়ায়। যেখানটায় সিলেট কে বাংলার অন্যান্য এলাকার মানুষজন দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবেই চেনে এবং সমীহ করে। এখানকার মানুষজনের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। এ জনপদের মানুষের মেলবন্ধনের মাঝে মিথস্ক্রিয়া এবং স্বর্গীয় সুখানুভূতি চাউর হয়।কেনই বা হবে না? প্রাচীন যুগের শুরুতেই এখানটায় বসতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ অঞ্চল মূলত বাংলাদেশের উত্তর-পুর্বাংশে অবস্থিত। যাকে ঘিরে হবিগঞ্জ সুনামগঞ্জ মৌলভীবাজার এবং সিলেটের ভৌগোলিক অঞ্চল বিস্তৃত। যার উত্তরে খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় পূর্বে কাছাড় দক্ষিণে ত্রিপুরা পশ্চিমে কুমিল্লা ময়মনসিংহের সীমানা রয়েছে।পর্যটন হাওর পাহাড় টিলা গ্যাস তেলে ভরপুর এ অঞ্চল যেন নিজেদের মাঝে আলাদা সত্তার জন্ম দিয়েছে।ফলশ্রুতিতে এ জনপদের অধিবাসীরা নিজেদেরকে সিলেটী ভাবতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এতদাঞ্চল মানুষের ভালোবাসা এবং ভূ-প্রাকৃতিক নৈসর্গিক আবহের কারণে ই আবহমানকাল থেকে দেশি এবং বিদেশীদের কাছে আলগা কদরের পাত্র হয়েছে।যার কারনে দেখা যায় ইবনে বতুতার ভারতবর্ষ ভ্রমণলিপিতে আফসোসের সুরেই বলেছিলেন শ্রীহট্ট পরিভ্রমণ না হওয়া পর্যন্ত আমার ভারত ভ্রমণ শেষ হলো বলে মনে করি না। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন এ অঞ্চলের রূপে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন সিলেট একটি কবিতাময় পরিবেশের আদি নিবাস। এখানে কবি না হয়ে পারা যায় না। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল Sylhet is Bengal but with a difference এসব ভেবে রোমাঞ্চিত হই। এ জনপদের ভূমিপুত্র হতে পেরে গর্ব বোধ হয়।জালালাবাদের অতিথিপরায়ণ মনোভাবের বেশ সুনাম রয়েছে। এ যেন আত্মার আত্মীয়।পরিচয় নেই জানা নেই ভৌগলিক সংশ্লিষ্ট ই পরস্পরের মাঝে হরি হরি আত্মার ভাব তৈরি করেছে। এ যেন কতকালের পরিচয়! গানের কথায় এর প্রমাণ ও মিলে।
সিলেট ফাইলে যেমন তেমন
ঢাকা’ত ফাইলে খৈ “আসেন খেমং”
লন্ডন ফাইলে ধরিয়া খৈ “ও আমার সিলটি ভাইসাব”
এ যেন হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি এবং ব্যাকুলতা।ঢাকা শহরে ভাতের হোটেল এবং বাখরখানির সংশ্লিষ্ট মানুষজনের সাথে দেখা হলেই আপ্যায়নের কমতি রাখেনা।কিসের টান? দেশের বাইরে বিদেশ বিভুইয়ে দেখা পেলেই জড়িয়ে ধরে সিলটী ভাইসাব বলে বুলি আওড়ায়। তখন প্রাণ মন জুড়িয়ে যায়।বিলেতে দেখা পেলেও ভাতের হোটেলে স্বজনের খোঁজখবর নেয়া হয় এবং হাতে গুঁজে দেয় পাউন্ড।যা আজও বংশ পরস্পরায় চলমান। এসবেই সুখ- যা কিনা অন্যদের থেকে আলাদাভাবে ভাবতে রসদ যোগায়।
শাহজালাল শাহ পরানের আগমনের বদৌলতে এ অঞ্চলে শান্তির ফলগুধারা বহমান।যেখানটায় তিনশত ষাট আউলিয়া শুয়ে আছেন, একমাত্র এ কারণে ই সারা বাংলার আবাল বৃদ্ধ বণিতার কাছে এ অঞ্চলের সম্মান ও ইজ্জত অনেক বেশি।ফলতঃএ অঞ্চল কে আধ্যাত্মিক রাজধানীর তকমায় ভূষিত করা হয়।এ কম কিসের?প্রকৃতির নয়নাভিরাম হাতছানি এবং স্রষ্টার নানাবিধ উপঢৌকন যেন এ অঞ্চলের বাড়তি পাওনা। আবহাওয়া ও বেশ স্বাস্থ্যকর।এ অঞ্চল বসবাসের জন্য শান্তি এবং আরামের। এখানকার রাজনীতি অন্য এলাকা থেকে বেশ ব্যতিক্রম।নেতায় নেতায় ভাব চোখে দেখার মত।নানামতের মূল্যায়ন সহবস্থান পারস্পরিক সম্পর্ক ই এলাকার শ্রী বৃদ্ধিতে সহায়ক শক্তি হিসেবে জ্বালানি সরবরাহ করছে।
সিলেটি মানুষের ভাষা এবং সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ।এখানকার মানুষের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে। যা নাগরী হিসেবেই সমাদৃত। এসব ও বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে একে আলাদা আসনে সমাসীন করেছে। বাংলা সাহিত্যের পালকে গৌরবের সংযুক্তিতে বৃহত্তর সিলেটের কবি সাহিত্যিকদের বেশ সুনাম রয়েছে। মধ্যযুগে সৈয়দ সুলতান দৌলত কাজী মাগন ঠাকুর মোহাম্মদ ছগীর উল্লেখযোগ্য।কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর রসবোধ এবং জিব্রাইলের ডানার শাহেদ আলী বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের মনে নতুনত্ব এনে দিয়েছে। সাহিত্য ও ভাষা আন্দোলনে মুসলিম সাহিত্য সংসদের ভূমিকা ও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মরমী কবি হাসান রাজা রাধারমন দত্ত প্রত্যেকেই যেন স্ব স্ব প্রতিভায় প্রজ্জ্বলিত তারা।
প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক অবয়ব এ অঞ্চলে গুণীজনের সমাবেশ ঘটাতে সহযোগিতা করেছে। চারণ শিল্পী বাউল আব্দুল করিমের অনবদ্য সৃষ্টি ও এ অঞ্চলের সুখ্যাতির পালকে নতুন হাওয়ার সংযোজন করেছে। ভাটি বাংলার রামকানাই দাস সুষমা দাস সুহাসিনী আরকুম শাহ দূরবীন শাহ সফল অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান আবুল মাল আবদুল মুহিত এম এস কিবরিয়া শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর ড. আব্দুর রশিদ সহ অসংখ্য গুণীর প্রসূতিগার এ মাটি ও বাতাস।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ হেন ক্ষেত্র নেই যেখানটায় এ জনপদের মানুষরা সক্রিয় ছিল না। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে জনতা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত হয় । মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক বিভাজনে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ার অস্তিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত। জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী এম এ রব সি আর দত্ত মানিক চৌধুরীদের স্বাধিকার আদায়ে বীরত্ব সর্বজনবিদিত। প্রবাসী সিলেটিরা বিশেষত বিলেতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন এবং অর্থ সংগ্রহে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী স্যার ফজলে হাসান আবেদের নাম ও মুক্তিসংগ্রামে সুনামের সাথে জড়িত।স্বাধীনতা ভাষা আন্দোলন সহ অধিকার সংশ্লিষ্ট সব উত্তাপে এ অঞ্চলের সরব সম্পৃক্ততা ছিল।
এখানকার খাবারের সুখ্যাতি জগৎজোড়া। বিলেতে সিলেটি কারির বেশ কদর। সাতকরা জারা লেবু আদাজামি ভোজন রসিকদের ভালোবাসায় সিক্ত। মানুষজন হিদলের শিরা আখনী পাতলা খিচুড়ি বেশ পছন্দ করে এবং কোরবানির ঈদে চালের রুটি আর গো-মাংস অপেক্ষায় থাকে সারা বছর।এ অঞ্চল ঐতিহ্যগতভাবে বেশ শক্তিশালী। সিলেটের শীতলপাটি তৎকালীন মোগল রাজ দরবারেও সমাদৃত ছিল এবং মনিপুরী তাঁত পোশাকপ্রেমীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এখানটায় কি নেই? কমলা আনারস লেবুর সুশোভিত গালিচা হৃদয়ের মাঝে সবুজাবের হিন্দোল জাগায়।নানা জাতের দেশীয় মাছের উপস্থিতি এবং শীতে অতিথি পাখির আগমন যেন অন্যরকম সৌন্দর্যের পরিবেশ নিশ্চিত করে।
এ অঞ্চল পর্যটনের লীলাভূমি।সাম্প্রতিক সময়ে হাওর পর্যটনের প্রসার এসবে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনন করেছে। সারা বছর ই ভ্রমন পিপাসুদের কাছে সিলেটের কদর রয়েছে। পুরো বিভাগ জোরেই পর্যটনের নানা স্পট। দ্বিতীয়টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কি নেই এ অঞ্চলে? তেল গ্যাস হাওর এসবে শ্রীবৃদ্ধি করেছে। প্রকৃতি কন্যা জাফলং সাদা পাথর মাধবকুণ্ড রাতারগুল সাতছড়ি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রেমা কালেঙ্গা হামহাম জলপ্রপাত শাপলা বিল পাংথুমাই লালাখাল বিছানাকান্দি বিথলং আখড়া ফ্রুটস ভ্যালী হাকালুকি টাংগুয়া সহ অনেক দর্শনীর স্থানের চাদর দ্বারা এ অঞ্চল আচ্ছাদিত। প্রতিনিয়ত এসব পর্যটকদের হাতছানি দেয়। বাসিন্দারা এসবে বাড়তি গৌরব অনুভব করে।
অতীতকাল থেকেই এখানকার মানুষজন সঙ্গ প্রিয় এবং মিশুক।পরিবেশ প্রতিবেশ বৈচিত্র্যময়। ঐতিহ্য ভাষা এবং সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ থাকায়, এসব মানুষজনের মাঝে আনন্দ এবং প্রেরণার অনুভূতি দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় শ্রদ্ধাবোধ চোখে পড়ার মতো। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি মিলেমিশে থাকার ঐতিহ্য বেশ পুরনো, এখানটায় শ্রী চৈতণ্যের আতুড়ঘর ও রয়েছে।আজ নানা কারণে এ জনপদ রক্তাক্ত। বিশেষত মেধা পাচার এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ভালোবাসার উঠোনে ক্ষতের তিলক এঁকে দিয়েছে। সিলেটিরা বেশ আমুদে এবং রসিক।পারস্পরিক সম্প্রীতি এবং বন্ধন দৃঢ়।বিশ্বের যেখানটায় এ অঞ্চলের মানুষজন রয়েছে স্বভাবতই যেন এক টুকরো সিলেট গড়ে উঠেছে। সিলেটিরা নিজেদের স্বকীয়তায় বিশ্বাসী এবং একে লালন ও করে। তাইতো প্রতিধ্বনিত্ব হয়
সুরমা গাঙ্গর পারো বাড়ি,
শাহজলালর উত্তরসুরী,
দেশ বিদেশে বেটাগিরি..
আমরা হক্কল সিলটী”
এসবেই মূলত সিলেটি ভাইসাবদের সম্পর্কের রসায়ন”। ভালো থাকুক সিলেট সমৃদ্ধ হোক এ জনপদ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সিলেট বিশ্বকে নেতৃত্ব দিক। এখানকার সম্প্রীতি কৃষ্টি কালচার ভালোবাসা মায়ার বন্ধন জাগ্রত থাকুক। (কৃতজ্ঞতা : লিখাটি জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিকীতে প্রকাশিত)
লেখকঃ সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: alioakkas@gmail.com
নিজস্ব সংবাদ : 









