শাহাবুদ্দিন শুভ :: গোপলার বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সূচনা: এক অধ্যায়
আমাদের গোপলার বাজার উচ্চ বিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে যখন, তখন এটি ছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আমি যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই, স্কুলটি সবে মাত্র একটি পাকা ঘর পেয়েছিল। ঘরের উপরে ছিল টিনের ছাউনি, আর নিচে ছিল কাঁচা মাটি। উচ্চ-নিচু মাটির কারণে বেঞ্চগুলো নড়াচড়া করত, যা পড়াশোনায় বাধা সৃষ্টি করত। তবুও আমাদের মনোবল ছিল অটুট। এখন সেই স্কুলে একাধিক বহুতল ভবন, আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রয়েছে। এই উন্নয়নের পেছনে ছিলেন আমাদের দুই প্রিয় শিক্ষক—শহীদ স্যার ও জুহেদ স্যারের অন্যতম অবদান।
শহীদ স্যার: একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক
আমাদের স্কুলের জন্য শহীদ স্যার ছিলেন এক অনন্য অনুপ্রেরণা। স্কুলের শুরু থেকে দাঁড় করানো এবং সেই সময়ের সীমাবদ্ধ অবস্থায় টিকে থাকার পেছনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি শুধু শিক্ষায় নয়, গ্রামীণ উন্নয়নে ও সমানভাবে ভূমিকা রেখেছেন। শুনেছি, তিনি এলাকাবাসীকে নিয়ে হেঁটে বাঁশ, কাঠ এবং নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করতেন। এমন একজন মানুষের কাছে শুধু পড়াশোনা নয়, জীবনবোধও শিখেছি আমরা।
শহীদ স্যার ছিলেন একজন স্বতঃসিদ্ধ লেখক। আমি যখন ক্লাস ফাইভে ছিলাম, তখন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। তার পড়ানোর ভঙ্গি এতটাই সুন্দর ছিল যে, আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তিনি আমাদের কবিতা ও ছড়া লেখার প্রতি অনুপ্রাণিত করতেন। একদিন আমি তার জন্য একটি লেখা নিয়ে গেলে তিনি আমাকে বেশ উৎসাহ দিলেন। সেই উৎসাহ থেকেই আমার লেখালেখির পথচলা শুরু।
জুহেদ স্যার: আধুনিকতার প্রতীক
অন্যদিকে, জুহেদ স্যার ছিলেন আধুনিকতার প্রতীক। তিনি সিলেটের শহরতলীতে বেড়ে ওঠার কারণে একজন স্মার্ট, পরিশীলিত ও প্রগতিশীল মনোভাবের মানুষ ছিলেন। তার রুচিশীল পোশাক ও চালচলন আমাদের মুগ্ধ করত। ক্লাসে তার উপস্থিতি সবসময় প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয় ছিল। তিনি ছাত্রদের প্রতি যত্নশীল ছিলেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত জীবনে উন্নতি করার জন্য সবসময় পরামর্শ দিতেন।
স্কুল জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলো
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় শহীদ স্যার ও জুহেদ স্যার মিলে স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু করেন। এতে অংশ নেওয়া আমাদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। ওই সময় থেকেই আমাদের স্কুলের উন্নয়নের গতি শুরু হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব শহীদ শাহ এ এম এস কিবরিয়া সরাসরি স্কুলটিকে এসএসসি পরীক্ষার অনুমতি দেন। তার উদ্যোগে স্কুলে নতুন ভবনের কাজ শুরু হয়, যা আমাদের পড়াশোনার পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করে।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমি আউশকান্দি র.প উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য টিসি নিতে গেলে, শহীদ স্যার ও জুহেদ স্যার আমাকে যেতে দিতে চাননি। কারণ, আমি ছিলাম ক্লাসের ফার্স্টবয়। তাদের অনুরোধ সত্ত্বেও, আমি আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে অন্যত্র চলে যাই। তবুও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কখনও ছিন্ন হয়নি।
স্যারদের বিদায়: এক হৃদয়বিদারক অধ্যায়
শহীদ স্যার চাকরি ছেড়ে তার বাড়ি মাধবপুরে চলে যাওয়ার পর আমাদের যোগাযোগ কমে যায়। একবার সিলেটে তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। সেই ভালোবাসার স্মৃতি আজও হৃদয়ে অম্লান। কয়েক বছর আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নেন।
সম্প্রতি জুহেদ স্যারও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গেলে বাজারে তার সঙ্গে দেখা হতো। দুর থেকে হাসিমুখে কাছে এসে জড়িয়ে ধরতেন, খোঁজখবর নিতেন। তার এই ভালোবাসার ছোঁয়া আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। স্যারের মৃত্যুর পর সিলেট থেকে তার মরদেহ আমাদের স্কুলে নিয়ে আসা হয়। অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন, যা প্রমাণ করে স্যার কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।
স্মৃতির সরণি বেয়ে
আজও আমার ভাগ্নি ও চাচাতো বোনদের মুখে স্যারের আলোচনা শুনি। তাদের কথায় স্নেহের যে ছাপ ফুটে ওঠে, তা আমাকে স্যারের প্রতি আরও কৃতজ্ঞ করে তোলে। তারা শুধু শিক্ষক ছিলেন না; তারা ছিলেন আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক।
শেষ কথা
আজ শহীদ স্যার ও জুহেদ স্যার আমাদের মাঝে নেই—এই সত্য মেনে নেওয়া বড়ই কঠিন। তাদের স্মৃতি, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা আমাদের জীবনের অমূল্য সম্পদ। আল্লাহ তাদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
স্যার, আপনারা চিরকাল আমাদের হৃদয়ে অমলিন থাকবেন।
নোট: যেহেতু এই দুইজন স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাই শুধু উনাদের নিয়ে স্মৃতি চারণের জন্য আমার এই লেখা।