ঢাকা ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পর্যটন এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৪:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

জামিউল আহমেদ :: ধেয়ে আসছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ঢেউ। তাতে কারো পৌষমাস মনে হলেও অনেকের জন্য আবার সর্বনাশ। কেন না বিশেষ করে মেশিন তথা যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থাকে সে অকপ্লনীয়ভাবে সাইজ করে ছাড়বে। এতে শ্রমিক ঘাটতির দেশগুলোর জন্য সুখবর হলেও আমাদের মত শ্রমিক সরবরাহকারী দেশগুলোর জন্য কোন সুখবরতো নয়ই বরং মারাত্মক দুঃসংবাদ বটে।

কেন না আমরা এখন আমাদের নেতিয়ে পড়া অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছি মুলত গার্মেন্টস এবং রেমিটেন্স দিয়ে। অথচ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার তান্ডব সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি এই দুটোকেই পেয়ে বসবে। এতে চারিদিকে শ্রমিক ছাটাই শুরু হলে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্যাভিলিয়নে ফিরতে হবে। আবার গার্মেন্টস খাতকে মোটামোটি অর্ধমৃত করে ফেলার ফলশ্রুতিতে তাকেও ব্যাপক শ্রমিক ছাটাইয়ে যেতে হবে।

এতে সৃষ্ট সমস্যায় পড়তে হবে উভয় খাত থেকে ঘর ফেরা শ্রমিককূলকে সামাল দেয়া নিয়ে। তাদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে না রাখলে শুধু যে আম যাবে তা নয় ছালাও যাবে। তখন বিরাজিত উভয় সংকট মোকাবেলায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ইসলামতন্ত্রের ফেরিওয়ালা কিংবা জাতের বড়াই ও চেতনার জুস বিক্রেতাদের কারো তখন মাঠে পাওয়া যাবেনা। সুবিধাবাদী আমলা আর সরকারের চারপাশে ঘুরঘুর করা অর্থনীতির ছবকদাতারা পালন করবেন নীরবতা।

কেন না কোন জাতির মগজে যখন পচন ধরে তখন সে তার নিজের পরিচিতি, সম্ভাবনা, ভবিষ্যত সবকিছু ভুলে বসে। খেই হারিয়ে আসল রেখে নকল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যা কিনা সুস্পষ্ট পতনের লক্ষণ যেখানে পরিষ্কার চোখের দৃষ্টি হয়ে যায় চোখ থাকিতে অন্ধের মত। আমরাও তাই এবং তা নাহলে আমরা আমাদের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবেলার জন্য প্রাপ্ত সম্পদগুলোও চিহ্নিত করে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তাই করতাম।

এটি মানতেই হবে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতির বিপদসংকুলতা কাটিয়ে উঠার জন্য আমাদের কৃষি এবং পর্যটনের কোন বিকল্প নেই। এই দুটি খাতের মধ্যে কৃষি আমাদের আদি খাত এবং অর্থনীতিও কৃষি নির্ভর। আবার পর্যটন আদি নাহলেও এই খাতটির সম্ভাবনা ছিলো অবারিল। অথচ কৃষি পায়নি যথাযথ পৃষ্টপোষকতা ও সহযোগিতা এবং পর্যটন পায়নি আন্তরিকতা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা।

লক্ষ্যণীয়, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে বেকারত্ব এবং দারিদ্রতা আমাদের মূল সমস্যা। যা মোকাবেলায় বিশেষ করে বেকারত্ব দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প নেই। আর তা পরিকল্পনামাফিক নির্বিঘ্ন ও যুতসই করার জন্য শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের প্রসার, কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ এবং পর্যটন উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। অথচ এখানেই আমাদের কি সরকার কি চিন্তক তথা অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং সমাজবিদ সবাই একযোগে শুধু ব্যর্থই নন নীরব-নিথর ও অন্ধ।
আধুনিক বিশ্বে এবং সর্বসাকুল্যে কর্মসংস্থানের জন্য পর্যটনই হচ্ছে সবার উপরে এবং ধারণারও বাইরে। কেন না পৃথিবীর মোট যে কর্মসংস্থান তার প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন হচ্ছে এই পর্যটন শিল্পের। এমন কি ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এবং ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাবলুটিটিসি) এর গবেষণায় দেখা গেছে নতুন চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন পর্যটনের। যেজন্য গোটা দুনিয়া এখন পর্যটন নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

লাগবে নাইবা কেন যেখানে বিশ্বসংস্থাগুলো বয়ান দিচ্ছে পর্যটনে কর্মসংস্থানের মাহাত্ব্য নিয়ে। যেমন বিশ্ব অর্থনীতির মুরুব্বি বিশ্বব্যাংক বলছে, “২০২৪ সালে, পর্যটন বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ ছিল, যা বৈশ্বিক জিডিপিতে ১০.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রেখেছিল। এই খাত বিশ্বব্যাপী ৩৫৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল, যা প্রতি দশটি কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রায় একটি, যা শ্রমবাজারে এর কেন্দ্রীয় ভূমিকা তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।”

আবার ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাবলুটিটিসি) প্রতি বছর বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ এবং ২৮ টি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভ্রমণ ও পর্যটনের অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের প্রভাবের উপর প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের দেয়া সর্বশেষ ভাষ্য হচ্ছে, “ভ্রমণ ও পর্যটন কর্মসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০২৪ সালে, এই খাত বিশ্বব্যাপী মোট ৩৫৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থানকে সমর্থন করেছিল, যা প্রায় ১০ জনের মধ্যে ১ জন।”

অপরদিকে জাতিসংঘ ঘোষণায় ২০৩০ সালের মধ্যে যে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” বা এসডিজি ঠিক করা হয়েছে তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্রতা নিরসন। এজন্য নির্ধারিত সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রার অন্তত চারটি সরাসরি এবং বাকীগুলো পরোক্ষভাবে পর্যটন সম্পৃক্ত। সেই পর্যটন শিল্পে আবার আমাদের সম্ভাবনা অবারিল। কেন না আমাদের যেমনি রয়েছে পর্যাপ্ত পর্যটন সম্পদ তেমনি রয়েছে পর্যাপ্তের বেশি জনসংখ্যা। যা জনসম্পদে পরিণত করতে পারলেই বাজিমাত।

অথচ আমাদের সরকারগুলো অকর্মন্য এবং বিশেষ করে অর্থনীতিবিদরা বাকরুদ্ধ। পর্যটনের কপাল মন্দ না হলে এমন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার সক্রিয় না থেকে পারতোনা। আবার অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা তাদের ভিশন এবং মিশনে পর্যটনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে পারতোনা। তাই বলতে হয়ে এরা অন্ধ, অকর্মণ্য, অযোগ্য এবং বাতিলযোগ্য। বিষয়টি কতাটা যুক্তিযুক্ত তা আমরা জানার চেষ্টা করে দেখতে পারি পর্যটন শিল্পে বিরাজিত কর্মসংস্থানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় পর্যটন বর্তমানে তার যে যে অবদানের জন্য বিশ্বের অন্য সব শিল্পকে টেক্কা দিয়ে শীর্ষে আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, দারিদ্রদূরীকরণ, সংস্কৃতি সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন। তবে, দেশ ভেদে এগুলোর তারতম্য থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ, সব দেশের সম্ভাবনা এবং সুযোগ-সুবিধা একই রকম নয়। সেই বিবচনায় আমাদের অবস্থান যে সুদৃঢ় তা আমরা বিশ্বের দিকে চোখ ফিরালেই বুঝতে সক্ষম হবো।

যাহোক, এটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে পর্যটন অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতের তুলনায় বেশি শ্রমঘন। “ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ” ছয়টি উন্নয়নশীল দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যদিও কৃষির তুলনায় কম তবুও অ-কৃষি কার্যক্রম এবং বিশেষ করে উৎপাদন খাতের তুলনায় পর্যটন অনেক অনেক বেশি শ্রমঘন। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেশিরভাগ নতুন কর্মসংস্থান পর্যটন খাতের মাধ্যমে তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ দেশেই সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে পর্যটন একটি এবং শহর ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তরুণ ও মহিলাদের জন্য কর্মশক্তিতে দ্রুত প্রবেশের একটি মাধ্যম।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে পর্যটনে কর্মসংস্থানের যে হিস্যা তাতে মহিলারা ৫৪ শতাংশ নিয়ে পুরুষদের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে। আবার বয়স বিচারে ১৫-২৫ বছরের তরুণরা এগিয়ে। তবে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, পর্যটনে কর্মসংস্থানের প্রভাবের মাত্রা পর্যটন ব্যয়ের পরিমাণ এবং কর্মসংস্থান গুণকের আকারের উপর নির্ভর করে। আই এল ও ২৪ অনুসারে পর্যটন খাতে একটি চাকুরি পর্যটন সম্পর্কিত অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে প্রায় ১.৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। যেজন্য পর্যটন খাত ৩৫৭ মিলিয়নেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে যা বিশ্বব্যাপী কর্মশক্তির ১০ শতাংশ।

আবার পর্যটন খাত অ-দক্ষ বা আধা-দক্ষ কর্মীদের জন্য তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থানের একটি সমৃদ্ধ উৎস; যা দরিদ্রদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলকও বটে। যেজন্য পর্যটন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অদক্ষ এবং আধা-দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে থাকে। আবার পর্যটন যে কেবল কর্মসংস্থানই তৈরি করতে পারে তা নয় বরং এর মধ্যে ‘ভালো কর্মসংস্থান’ তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে। যা কিনা স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ এবং আরও মনোরম কাজের পরিবেশ দ্বারা চিহ্নিত।

পর্যটনে উচ্চ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা একটি বিশেষ সুযোগ। এটির প্রয়োজন এজন্য যে পর্যটন কর্মসংস্থানের মান সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রমবাজার এবং পর্যটন মৌসুমের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই কর্মীদের প্রায়শই চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিযুক্ত করা হয় যা সময়সীমার মধ্যে সীমিত যেমন খণ্ডকালীন, মৌসুমী এবং নৈমিত্তিক চুক্তি। এছাড়াও নমনীয় কর্মসংস্থান অনেক তরুণ কর্মীর জন্য সুবিধাজনক যারা পড়াশোনা করছেন অথবা পরে অন্যান্য খাতে যাওয়ার লক্ষ্য রাখেন। একইভাবে যেসব মহিলা কর্মী সন্তানসম্ভবা অথবা যাদের বাচ্চা রয়েছে তাদের জন্যও এটি একটি বিশেষ সুযোগ।

এজন্য মনে রাখতে হবে, শেষতক সদাশয় সরকারের উপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। কেন না সরকারি হস্তক্ষেপ শ্রমবাজারের চূড়ান্ত ফলাফলকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যার ফলে দরিদ্রদের আয়ের উপর প্রভাব পড়তে পারে। যেজন্য সরবরাহের দিক থেকে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে পর্যটন অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলভাবে অবদান রাখার দক্ষতা যেমন ভাষা বা আতিথেয়তা দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করার জন্য উন্নত মানের প্রশিক্ষণ প্রদানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আবার চাহিদার দিক থেকে, সরকার পর্যটন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত চাকুরী বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এমন একটি নিয়ন্ত্রক পরিবেশের মাধ্যমে মজুরি স্তর এবং দরিদ্রদের নিয়োগ উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে।

এসব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেন না ইতোমধ্যে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই এর যুথসই ব্যবহার পর্যটনের প্রচার ও প্রসার তথা উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তবে, বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার আগে দেখা দরকার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আসলে কি এবং তারপর পর্যটনের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত করা যায় বা যাচ্ছে।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) হচ্ছে এমন উন্নত এক প্রযুক্তি যা কম্পিউটারসমূহকে নিজস্ব কল্পনা, যুক্তি এবং সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা দেয়। আরো সহজভাবে বলতে গেলে একটি যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, সেটিকে চিন্তা করানো কিংবা বিশ্লেষণ করানোর ক্ষমতা দেয়ার ধারণাটিকে সাধারণভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শেখা, সমস্যা সমাধান, উপলব্ধি এবং ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা। যেজন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই কম্পিউটারকে এমন কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম করে তোলে যা সাধারণত মানুষের বুদ্ধিমত্তায় প্রয়োজন হয়।

তাই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই পর্যটনের ক্ষেত্রে গ্রাহক অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি, কার্যক্রম অপ্টিমাইজ (সর্বোত্তম বা উন্নত করা) এবং উদ্ভাবন চালনা করে পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এজন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সরঞ্জামগুলি ভ্রমণ পরিকল্পনা, বুকিং এবং অভিজ্ঞতার ধরণকে রূপান্তরিত করছে। তার সাথে ব্যক্তিগত বিষয়ে সুপারিশ, স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক সহায়তা এবং দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থাপনা প্রদান করছে। যা থেকে সরাসরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে উন্নত গ্রাহক পরিষেবা; কার্যপরিচালন দক্ষতা; ভ্রমণ পরিষেবায় উদ্ভাবন; চৌকস ভ্রমণ; ব্যক্তি সম্পৃক্ত ভ্রমণসুচী, বাস্তবতা নির্ভর ভ্রমণ, গতিশীল মূল্য, স্মার্ট লাগেজ, এআই-চালিত চ্যাটবট, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ, মূখচ্ছবি সনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তায়।

তবে, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা হচ্ছে চ্যাটবটের। এই চ্যাটবট হচ্ছে এক ধরনের আলাপচারী এজেন্ট বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এটি শ্রবণভিত্তিক কিংবা পাঠ্যভিত্তিক পদ্ধতিতে এক বা একাধিক মানুষের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়ে বানানো হয়। তাই এই চ্যাটবটগুলি ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, স্কাইপি, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মত সোশাল মিডিয়া সাইটগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে যাতে ব্যবহারকারীদের আরো ব্যক্তিভিত্তিক বুকিং অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়। এতে অনেক পর্যটন ব্যবসা এ আই উন্নয়ন এবং স্থাপনায় মানুষের ভূমিকার উপর জোর দিয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করছে। যেমনটি আমরা দেখতে পাইঃ
একঃ ইতোমধ্যে ট্র্যাভেল এজেন্টদের স্থান দখলে নিয়েছে এ আই সহকারী এবং বুদ্ধিমান চ্যাটবট। যা ভ্রমণকারীদের অনলাইনে ফ্লাইট এবং থাকার ব্যবস্থা বুক করা ছাড়াও যানবাহন ভাড়া করতে দেয়।
দুইঃ অনেক অনলাইন ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম পর্যটক গন্তব্য, থাকার ব্যবস্থা এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য এ আই ব্যবহার করছে।
তিনঃ অনেক হোটেল এবং বিমান সংস্থা গ্রাহকদের সহায়তা করার জন্য এ আই চ্যাটবট ব্যবহার করছে।
চারঃ ডেস্টিনেশন ম্যানেজমেন্ট অরগানাইজেশন (ডিএমও) বা গন্তব্য বিপণন সংস্থাগুলি ভ্রমণকারীদের জন্য কন্টেন্ট তৈরী করতে ক্রমবর্ধমানভাবে এ আই ব্যবহার করছে।
পাঁচঃ হোটেল এবং বিমান সংস্থাগুলি চেক-ইনগুলিকে সহজতর করতে এবং রুমের পছন্দগুলি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসতে কিংবা আপগ্রেডের পরামর্শ দিতে এ আই ব্যবহার করছে।

এজন্য পর্যটন বোদ্ধাদের পরামর্শ হচ্ছে, এ আই-কে মানবিক হিসেবে দেখানোর পরিবর্তে পর্যটন ব্যবসাগুলির উচিৎ তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে এ আই চালিত অভিজ্ঞতাগুলিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে মনোনিবেশ করা। কেন না পর্যটনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ মানুষের স্পর্শ প্রতিস্থাপনের বিষয় নয় – বরং স্মার্ট, মানব-অবহিত প্রযুক্তির মাধ্যমে এটিকে শক্তিশালী করার বিষয়।

তাই কালক্ষেপণ না করে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শুধু পর্যটন নয় কৃষিতেও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেন না কৃষির সাথে রয়েছে পর্যটনের নিবিড় সম্পর্ক। তাছাড়া এ আই এর জন্য অগ্রাধিকারের যে নয়টি খাত রয়েছে তাতেও ইতোমধ্যে কৃষি স্থান করে নিয়েছে। এমতাবস্থায় সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোন উদ্ভাবন মানব কল্যানের জন্য হয়ে থাকলেও শুধু অব্যবহার বা অপব্যবহার দ্বারা তা অভিশাপে পরিণত হয়ে যেতে পারে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)।

ট্যাগস :

পর্যটন এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা

আপডেট সময় ০৪:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

জামিউল আহমেদ :: ধেয়ে আসছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ঢেউ। তাতে কারো পৌষমাস মনে হলেও অনেকের জন্য আবার সর্বনাশ। কেন না বিশেষ করে মেশিন তথা যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থাকে সে অকপ্লনীয়ভাবে সাইজ করে ছাড়বে। এতে শ্রমিক ঘাটতির দেশগুলোর জন্য সুখবর হলেও আমাদের মত শ্রমিক সরবরাহকারী দেশগুলোর জন্য কোন সুখবরতো নয়ই বরং মারাত্মক দুঃসংবাদ বটে।

কেন না আমরা এখন আমাদের নেতিয়ে পড়া অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছি মুলত গার্মেন্টস এবং রেমিটেন্স দিয়ে। অথচ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার তান্ডব সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি এই দুটোকেই পেয়ে বসবে। এতে চারিদিকে শ্রমিক ছাটাই শুরু হলে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের প্যাভিলিয়নে ফিরতে হবে। আবার গার্মেন্টস খাতকে মোটামোটি অর্ধমৃত করে ফেলার ফলশ্রুতিতে তাকেও ব্যাপক শ্রমিক ছাটাইয়ে যেতে হবে।

এতে সৃষ্ট সমস্যায় পড়তে হবে উভয় খাত থেকে ঘর ফেরা শ্রমিককূলকে সামাল দেয়া নিয়ে। তাদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে না রাখলে শুধু যে আম যাবে তা নয় ছালাও যাবে। তখন বিরাজিত উভয় সংকট মোকাবেলায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ইসলামতন্ত্রের ফেরিওয়ালা কিংবা জাতের বড়াই ও চেতনার জুস বিক্রেতাদের কারো তখন মাঠে পাওয়া যাবেনা। সুবিধাবাদী আমলা আর সরকারের চারপাশে ঘুরঘুর করা অর্থনীতির ছবকদাতারা পালন করবেন নীরবতা।

কেন না কোন জাতির মগজে যখন পচন ধরে তখন সে তার নিজের পরিচিতি, সম্ভাবনা, ভবিষ্যত সবকিছু ভুলে বসে। খেই হারিয়ে আসল রেখে নকল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যা কিনা সুস্পষ্ট পতনের লক্ষণ যেখানে পরিষ্কার চোখের দৃষ্টি হয়ে যায় চোখ থাকিতে অন্ধের মত। আমরাও তাই এবং তা নাহলে আমরা আমাদের প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা মোকাবেলার জন্য প্রাপ্ত সম্পদগুলোও চিহ্নিত করে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেই চিন্তাই করতাম।

এটি মানতেই হবে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতির বিপদসংকুলতা কাটিয়ে উঠার জন্য আমাদের কৃষি এবং পর্যটনের কোন বিকল্প নেই। এই দুটি খাতের মধ্যে কৃষি আমাদের আদি খাত এবং অর্থনীতিও কৃষি নির্ভর। আবার পর্যটন আদি নাহলেও এই খাতটির সম্ভাবনা ছিলো অবারিল। অথচ কৃষি পায়নি যথাযথ পৃষ্টপোষকতা ও সহযোগিতা এবং পর্যটন পায়নি আন্তরিকতা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা।

লক্ষ্যণীয়, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে বেকারত্ব এবং দারিদ্রতা আমাদের মূল সমস্যা। যা মোকাবেলায় বিশেষ করে বেকারত্ব দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের কোন বিকল্প নেই। আর তা পরিকল্পনামাফিক নির্বিঘ্ন ও যুতসই করার জন্য শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের প্রসার, কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ এবং পর্যটন উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। অথচ এখানেই আমাদের কি সরকার কি চিন্তক তথা অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং সমাজবিদ সবাই একযোগে শুধু ব্যর্থই নন নীরব-নিথর ও অন্ধ।
আধুনিক বিশ্বে এবং সর্বসাকুল্যে কর্মসংস্থানের জন্য পর্যটনই হচ্ছে সবার উপরে এবং ধারণারও বাইরে। কেন না পৃথিবীর মোট যে কর্মসংস্থান তার প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন হচ্ছে এই পর্যটন শিল্পের। এমন কি ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এবং ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাবলুটিটিসি) এর গবেষণায় দেখা গেছে নতুন চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন পর্যটনের। যেজন্য গোটা দুনিয়া এখন পর্যটন নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

লাগবে নাইবা কেন যেখানে বিশ্বসংস্থাগুলো বয়ান দিচ্ছে পর্যটনে কর্মসংস্থানের মাহাত্ব্য নিয়ে। যেমন বিশ্ব অর্থনীতির মুরুব্বি বিশ্বব্যাংক বলছে, “২০২৪ সালে, পর্যটন বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ ছিল, যা বৈশ্বিক জিডিপিতে ১০.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রেখেছিল। এই খাত বিশ্বব্যাপী ৩৫৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল, যা প্রতি দশটি কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রায় একটি, যা শ্রমবাজারে এর কেন্দ্রীয় ভূমিকা তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।”

আবার ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডাবলুটিটিসি) প্রতি বছর বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ এবং ২৮ টি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভ্রমণ ও পর্যটনের অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের প্রভাবের উপর প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের দেয়া সর্বশেষ ভাষ্য হচ্ছে, “ভ্রমণ ও পর্যটন কর্মসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ২০২৪ সালে, এই খাত বিশ্বব্যাপী মোট ৩৫৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থানকে সমর্থন করেছিল, যা প্রায় ১০ জনের মধ্যে ১ জন।”

অপরদিকে জাতিসংঘ ঘোষণায় ২০৩০ সালের মধ্যে যে “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা” বা এসডিজি ঠিক করা হয়েছে তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্রতা নিরসন। এজন্য নির্ধারিত সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রার অন্তত চারটি সরাসরি এবং বাকীগুলো পরোক্ষভাবে পর্যটন সম্পৃক্ত। সেই পর্যটন শিল্পে আবার আমাদের সম্ভাবনা অবারিল। কেন না আমাদের যেমনি রয়েছে পর্যাপ্ত পর্যটন সম্পদ তেমনি রয়েছে পর্যাপ্তের বেশি জনসংখ্যা। যা জনসম্পদে পরিণত করতে পারলেই বাজিমাত।

অথচ আমাদের সরকারগুলো অকর্মন্য এবং বিশেষ করে অর্থনীতিবিদরা বাকরুদ্ধ। পর্যটনের কপাল মন্দ না হলে এমন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার সক্রিয় না থেকে পারতোনা। আবার অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা তাদের ভিশন এবং মিশনে পর্যটনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে পারতোনা। তাই বলতে হয়ে এরা অন্ধ, অকর্মণ্য, অযোগ্য এবং বাতিলযোগ্য। বিষয়টি কতাটা যুক্তিযুক্ত তা আমরা জানার চেষ্টা করে দেখতে পারি পর্যটন শিল্পে বিরাজিত কর্মসংস্থানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় পর্যটন বর্তমানে তার যে যে অবদানের জন্য বিশ্বের অন্য সব শিল্পকে টেক্কা দিয়ে শীর্ষে আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, দারিদ্রদূরীকরণ, সংস্কৃতি সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন। তবে, দেশ ভেদে এগুলোর তারতম্য থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ, সব দেশের সম্ভাবনা এবং সুযোগ-সুবিধা একই রকম নয়। সেই বিবচনায় আমাদের অবস্থান যে সুদৃঢ় তা আমরা বিশ্বের দিকে চোখ ফিরালেই বুঝতে সক্ষম হবো।

যাহোক, এটি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে পর্যটন অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতের তুলনায় বেশি শ্রমঘন। “ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ” ছয়টি উন্নয়নশীল দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যদিও কৃষির তুলনায় কম তবুও অ-কৃষি কার্যক্রম এবং বিশেষ করে উৎপাদন খাতের তুলনায় পর্যটন অনেক অনেক বেশি শ্রমঘন। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেশিরভাগ নতুন কর্মসংস্থান পর্যটন খাতের মাধ্যমে তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ দেশেই সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে পর্যটন একটি এবং শহর ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে তরুণ ও মহিলাদের জন্য কর্মশক্তিতে দ্রুত প্রবেশের একটি মাধ্যম।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে পর্যটনে কর্মসংস্থানের যে হিস্যা তাতে মহিলারা ৫৪ শতাংশ নিয়ে পুরুষদের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে। আবার বয়স বিচারে ১৫-২৫ বছরের তরুণরা এগিয়ে। তবে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, পর্যটনে কর্মসংস্থানের প্রভাবের মাত্রা পর্যটন ব্যয়ের পরিমাণ এবং কর্মসংস্থান গুণকের আকারের উপর নির্ভর করে। আই এল ও ২৪ অনুসারে পর্যটন খাতে একটি চাকুরি পর্যটন সম্পর্কিত অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে প্রায় ১.৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। যেজন্য পর্যটন খাত ৩৫৭ মিলিয়নেরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে যা বিশ্বব্যাপী কর্মশক্তির ১০ শতাংশ।

আবার পর্যটন খাত অ-দক্ষ বা আধা-দক্ষ কর্মীদের জন্য তুলনামূলকভাবে কর্মসংস্থানের একটি সমৃদ্ধ উৎস; যা দরিদ্রদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলকও বটে। যেজন্য পর্যটন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অদক্ষ এবং আধা-দক্ষ কর্মী নিয়োগ করে থাকে। আবার পর্যটন যে কেবল কর্মসংস্থানই তৈরি করতে পারে তা নয় বরং এর মধ্যে ‘ভালো কর্মসংস্থান’ তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে। যা কিনা স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ এবং আরও মনোরম কাজের পরিবেশ দ্বারা চিহ্নিত।

পর্যটনে উচ্চ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা একটি বিশেষ সুযোগ। এটির প্রয়োজন এজন্য যে পর্যটন কর্মসংস্থানের মান সংশ্লিষ্ট দেশের শ্রমবাজার এবং পর্যটন মৌসুমের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই কর্মীদের প্রায়শই চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিযুক্ত করা হয় যা সময়সীমার মধ্যে সীমিত যেমন খণ্ডকালীন, মৌসুমী এবং নৈমিত্তিক চুক্তি। এছাড়াও নমনীয় কর্মসংস্থান অনেক তরুণ কর্মীর জন্য সুবিধাজনক যারা পড়াশোনা করছেন অথবা পরে অন্যান্য খাতে যাওয়ার লক্ষ্য রাখেন। একইভাবে যেসব মহিলা কর্মী সন্তানসম্ভবা অথবা যাদের বাচ্চা রয়েছে তাদের জন্যও এটি একটি বিশেষ সুযোগ।

এজন্য মনে রাখতে হবে, শেষতক সদাশয় সরকারের উপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। কেন না সরকারি হস্তক্ষেপ শ্রমবাজারের চূড়ান্ত ফলাফলকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যার ফলে দরিদ্রদের আয়ের উপর প্রভাব পড়তে পারে। যেজন্য সরবরাহের দিক থেকে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে পর্যটন অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলভাবে অবদান রাখার দক্ষতা যেমন ভাষা বা আতিথেয়তা দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করার জন্য উন্নত মানের প্রশিক্ষণ প্রদানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আবার চাহিদার দিক থেকে, সরকার পর্যটন কর্মীদের জন্য উপযুক্ত চাকুরী বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এমন একটি নিয়ন্ত্রক পরিবেশের মাধ্যমে মজুরি স্তর এবং দরিদ্রদের নিয়োগ উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে।

এসব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন শিল্পে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেন না ইতোমধ্যে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই এর যুথসই ব্যবহার পর্যটনের প্রচার ও প্রসার তথা উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তবে, বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার আগে দেখা দরকার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা আসলে কি এবং তারপর পর্যটনের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার কিভাবে নিশ্চিত করা যায় বা যাচ্ছে।

কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) হচ্ছে এমন উন্নত এক প্রযুক্তি যা কম্পিউটারসমূহকে নিজস্ব কল্পনা, যুক্তি এবং সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা দেয়। আরো সহজভাবে বলতে গেলে একটি যন্ত্রকে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, সেটিকে চিন্তা করানো কিংবা বিশ্লেষণ করানোর ক্ষমতা দেয়ার ধারণাটিকে সাধারণভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শেখা, সমস্যা সমাধান, উপলব্ধি এবং ভাষা বোঝার মতো ক্ষমতা। যেজন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই কম্পিউটারকে এমন কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম করে তোলে যা সাধারণত মানুষের বুদ্ধিমত্তায় প্রয়োজন হয়।

তাই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই পর্যটনের ক্ষেত্রে গ্রাহক অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি, কার্যক্রম অপ্টিমাইজ (সর্বোত্তম বা উন্নত করা) এবং উদ্ভাবন চালনা করে পর্যটন শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এজন্য কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সরঞ্জামগুলি ভ্রমণ পরিকল্পনা, বুকিং এবং অভিজ্ঞতার ধরণকে রূপান্তরিত করছে। তার সাথে ব্যক্তিগত বিষয়ে সুপারিশ, স্বয়ংক্রিয় গ্রাহক সহায়তা এবং দক্ষ পরিচালনা ব্যবস্থাপনা প্রদান করছে। যা থেকে সরাসরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে উন্নত গ্রাহক পরিষেবা; কার্যপরিচালন দক্ষতা; ভ্রমণ পরিষেবায় উদ্ভাবন; চৌকস ভ্রমণ; ব্যক্তি সম্পৃক্ত ভ্রমণসুচী, বাস্তবতা নির্ভর ভ্রমণ, গতিশীল মূল্য, স্মার্ট লাগেজ, এআই-চালিত চ্যাটবট, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ, মূখচ্ছবি সনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তায়।

তবে, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা হচ্ছে চ্যাটবটের। এই চ্যাটবট হচ্ছে এক ধরনের আলাপচারী এজেন্ট বা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এটি শ্রবণভিত্তিক কিংবা পাঠ্যভিত্তিক পদ্ধতিতে এক বা একাধিক মানুষের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়ে বানানো হয়। তাই এই চ্যাটবটগুলি ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, স্কাইপি, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মত সোশাল মিডিয়া সাইটগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে যাতে ব্যবহারকারীদের আরো ব্যক্তিভিত্তিক বুকিং অভিজ্ঞতা প্রদান করা যায়। এতে অনেক পর্যটন ব্যবসা এ আই উন্নয়ন এবং স্থাপনায় মানুষের ভূমিকার উপর জোর দিয়ে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করছে। যেমনটি আমরা দেখতে পাইঃ
একঃ ইতোমধ্যে ট্র্যাভেল এজেন্টদের স্থান দখলে নিয়েছে এ আই সহকারী এবং বুদ্ধিমান চ্যাটবট। যা ভ্রমণকারীদের অনলাইনে ফ্লাইট এবং থাকার ব্যবস্থা বুক করা ছাড়াও যানবাহন ভাড়া করতে দেয়।
দুইঃ অনেক অনলাইন ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম পর্যটক গন্তব্য, থাকার ব্যবস্থা এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য এ আই ব্যবহার করছে।
তিনঃ অনেক হোটেল এবং বিমান সংস্থা গ্রাহকদের সহায়তা করার জন্য এ আই চ্যাটবট ব্যবহার করছে।
চারঃ ডেস্টিনেশন ম্যানেজমেন্ট অরগানাইজেশন (ডিএমও) বা গন্তব্য বিপণন সংস্থাগুলি ভ্রমণকারীদের জন্য কন্টেন্ট তৈরী করতে ক্রমবর্ধমানভাবে এ আই ব্যবহার করছে।
পাঁচঃ হোটেল এবং বিমান সংস্থাগুলি চেক-ইনগুলিকে সহজতর করতে এবং রুমের পছন্দগুলি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসতে কিংবা আপগ্রেডের পরামর্শ দিতে এ আই ব্যবহার করছে।

এজন্য পর্যটন বোদ্ধাদের পরামর্শ হচ্ছে, এ আই-কে মানবিক হিসেবে দেখানোর পরিবর্তে পর্যটন ব্যবসাগুলির উচিৎ তাদের দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে এ আই চালিত অভিজ্ঞতাগুলিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে মনোনিবেশ করা। কেন না পর্যটনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ মানুষের স্পর্শ প্রতিস্থাপনের বিষয় নয় – বরং স্মার্ট, মানব-অবহিত প্রযুক্তির মাধ্যমে এটিকে শক্তিশালী করার বিষয়।

তাই কালক্ষেপণ না করে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শুধু পর্যটন নয় কৃষিতেও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আই এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেন না কৃষির সাথে রয়েছে পর্যটনের নিবিড় সম্পর্ক। তাছাড়া এ আই এর জন্য অগ্রাধিকারের যে নয়টি খাত রয়েছে তাতেও ইতোমধ্যে কৃষি স্থান করে নিয়েছে। এমতাবস্থায় সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোন উদ্ভাবন মানব কল্যানের জন্য হয়ে থাকলেও শুধু অব্যবহার বা অপব্যবহার দ্বারা তা অভিশাপে পরিণত হয়ে যেতে পারে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)।