ডাঃ সোয়েতা ইসলাম :: অতি সম্প্রতি ইস্তাম্বুল সফরে গিয়েছিলাম। ইস্তাম্বুলের মাটিতে পা রাখার সেই মুহূর্ত এখনো চোখে ভাসে—নতুন শহরের রহস্যময় সৌন্দর্য, ইতিহাসে মোড়া বাতাসের গন্ধ, আর অচেনা এক সংস্কৃতির অনুরণন যেন ঘিরে রেখেছিল আমাকে। শহরের বুক চিরে যখন ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করছিলাম, তখন থেকেই কিছু নাম বারবার কানে ভেসে আসছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোড়ন জাগানো নামটি ছিল—ব্লু মসজিদ। এই মসজিদটির প্রকৃত নাম সুলতান আহমেদ মসজিদ, তবে এর অপার নীল কারুকাজ ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্য এটি বিশ্বজুড়ে ব্লু মসজিদ নামেই বেশি পরিচিত। ইস্তাম্বুল শহরের গর্ব এই মসজিদ শুধু তুরস্ক নয়, বরং পুরো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন, ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যশৈলীতে অতুলনীয় এক নিদর্শন।
ব্লু মসজিদটি নির্মিত হয় ১৬০৯ সালে, অটোমান সম্রাট সুলতান আহমেদ I এর আদেশে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি এই বিশাল প্রকল্পের সূচনা করেন। সম্রাটের নিজস্ব পরিকল্পনায় এবং তার অর্থায়নে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়, যাতে ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইস্তাম্বুলের অন্যতম একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা প্রাচীন ঐতিহ্যের আধুনিক সমন্বয়ের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মসজিদটির অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এর অভ্যন্তরীণ দেয়ালগুলিতে ব্যবহৃত নীল টাইলস, যা এই মসজিদকে ব্লু মসজিদ নামকরণের কারণ। মসজিদের দেওয়ালে প্রায় ২০,০০০ হাতে আঁকা İznik টাইলস রয়েছে, যা ফুল, পাতা এবং ইসলামী ক্যালিগ্রাফির নিখুঁত ডিজাইনে সজ্জিত। এই টাইলসগুলো মসজিদের অভ্যন্তরের চারপাশে এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে, তা মসজিদটির রূপকে যেন আরও উজ্জ্বল করে তোলে। বিশেষ করে এই টাইলসগুলির নীল রঙের কারণে, মসজিদটি এক অদ্ভুত রহস্যময় আভা তৈরি করে, যা ভ্রমণকারীদের কাছে একটি বিস্ময়কর দৃশ্য।
ব্লু মসজিদটির নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্যে এর বিশালতা এবং মহান অটোমান স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্ট। মসজিদের ছাদে এবং গম্বুজে সুক্ষ্মভাবে কাজ করা চিত্রকলাগুলি মুসলিম স্থাপত্যের অসাধারণ নিদর্শন। এই মসজিদটি ছয়টি মিনার দ্বারা সজ্জিত, যা আধুনিক বিশ্বে খুবই বিরল। এমনকি, এটি একমাত্র মসজিদ, যার ছয়টি মিনার রয়েছে—যা সুলতান আহমেদ I এর মক্কার কাবা শরীফের মিনারের সংখ্যা ৭টি করার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছিল।
এখানে যাওয়ার পর আমি লক্ষ্য করলাম, ব্লু মসজিদে আসা নন-মুসলিম পর্যটকদের সংখ্যা প্রচুর। মসজিদটি এমন একটি স্থান, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটে। মুসলিম দর্শনার্থীরা নামাজ আদায় করার জন্য এখানে উপস্থিত হন, পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরাও আসেন মসজিদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। নন-মুসলিমদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বিশেষ করে, মসজিদে প্রবেশের জন্য মেয়েদের মাথা ঢাকতে হাজার হাজার স্কার্ফ দেওয়া হয়, যাতে তারা মসজিদে প্রবেশের সময় শালীনতা বজায় রাখতে পারে।
ব্লু মসজিদে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এই মসজিদে নামাজ পড়ার সময় মুসল্লিরা এক এক করে ইমামের নেতৃত্বে নামাজ আদায় করেন। মসজিদটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং মুসলিম ঐতিহ্যের এক চিরন্তন প্রতীক হয়ে রয়েছে।
সবশেষে, আমি এক কথায় বলতে চাই—ব্লু মসজিদ ইস্তাম্বুলের প্রতিটি ভ্রমণকারীর জন্য একটি বিশেষ স্থান। এখানকার নীরব ঐতিহ্য, স্থাপত্যশৈলী, এবং শান্ত পরিবেশ সবাইকে এক অন্য অভিজ্ঞতা দেয়। এটি শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, বরং ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সাক্ষী। যারা ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্য ব্লু মসজিদ অবশ্যই একটি অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে।