জামিউল আহমেদ :: বাংলাদেশে সবচেয়ে উন্নত শিক্ষা এবং পর্যটন। সার্বিক পরিস্থিতি-পরিবেশ অন্তত তাই বলে। কেন না দেশে এখন সংস্কারের মহা ধুমধাম চলছে। এজন্য সর্বত্র সংস্কারের হালকা মৃদুমন্দ বাতাস থেকে শুরু করে দমকা হাওয়া, ঝড়ো হাওয়া সবই বিদ্যমান রয়েছে। তাইতো রাষ্ট্র সংস্কার আর শাসনতন্ত্র সংস্কার থেকে শুরু করে নারীকুল-প্রতিকূল হয়ে পূঁজিবাজার-চকবাজার সর্বত্রই সংস্কারের জশনে জুলুস আর খুশবু ছড়াচ্ছে। এসব সংস্কারের ছোট কিংবা বড় কোন ফরমেটেই নেই শুধু বাতি নিভে যাওয়া আলোকিত শিক্ষা আর আতুর হয়ে পড়ে থাকা ভ্রমণ কর্মকান্ডের পর্যটন।
কিন্তু কেন? উত্তর একেবারেই সহজ। নিশ্চয়ই এগুলোতে কোন সমস্যা নেই বরং ইতোমধ্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। আর তা নাহলে বলতে হবে সংস্কারের বিষয় নির্বাচনে অদূরদর্শিতা এবং বিচারিক জ্ঞানশূন্যতা এজন্য দায়ী। কেন না সংস্কার মানে অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল ছাফ করে সবকিছু তকতকে ঝকঝকে করা। সোজা বাংলায় মেরামত করা, পুনঃস্থাপনা করা এবং বিশ্বস্থ হওয়া। তাই সংস্কারের কাজই হচ্ছে অবহেলা, অনিয়ম, অনাচার, বেবিচার এবং দুর্নীতি-দুরাচারের শেকড় উপড়ে ফেলা। যাতে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাবলীলতা ও শক্তিমত্তা ফিরে আসে। আসে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ যা কিনা স্থবিরতা কাটিয়ে আবার উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
এই হলো সংস্কারের আসল পরিচিতি যার উপর ভিত্তি করে সংস্কারের বিষয় নির্বাচন করা হবে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে সংস্কারের জন্য প্রথমেই আসার কথা এই শিক্ষা এবং পর্যটন। কেননা প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় অগ্রগামীতা বলি কিংবা সমস্যা, অবহেলা এবং অনুন্নয়নের ধারা থেকে পিছিয়ে পড়া বলি কোনকিছু বিচারেই এগুলোকে সংস্কারের বাইরে রাখা যায়না। তাছাড়া এই খাতগুলো দেশের দুটি আদি খাত; যার একটি জাতির হৃদস্পন্দন ও মেরুদণ্ড এবং আরেকটি জাতির ভাত-কাপড়ের সংস্থান ও উন্নয়নের হাতিয়ার। আবার সম্ভাবনার দিক থেকেও এই দু’টি খাত সবার চেয়ে এগিয়ে।
কেন না আমাদের মত অতি জনবহুল ও অনিশ্চয়তার একটি দেশকে নিজের অস্থিত্ব রক্ষার মাধ্যমে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হলে এই দু’টির উন্নয়ন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। কারণ, আধুনিক বিশ্বে যে দেশের শিক্ষা ও গবেষণা যত উন্নত সেই দেশ তত উন্নত। আবার যে দেশের পর্যটন যত উন্নত সেই দেশ তত উন্নত। অথচ কাকতালীয়ভাবে কেবলমাত্র এই দু’টো খাত বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পরই তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। তার মধ্যে শিক্ষা তার প্রয়োজনের পথ ধরেই হাটিহাটি পা-পা করে যাত্রা শুরু করে। অন্যদিকে পর্যটন সম্ভাবনার বিচারে সবচেয়ে এগিয়ে থেকে অনেকটা নতুন হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে। আবার প্রাথমিকভাবে দু’টোই নিজেদেরকে মোটামুটি উন্নয়নের মহাসড়ক, প্রধান সড়ক, বিকল্প সড়ক ইত্যাদি না হলেও অন্তুত বেশ ভাল মেঠোপথে নিয়ে যেতে পেরেছিলো।
কিন্তু পরবর্তীতে স্বার্থান্বেষী মহল এবং তারোপরে চোর-টাউট-বাটপার-ধান্দাবাজ ইত্যাদির খপ্পরে পড়ে শুধু অবহেলার খাতায়ই নাম লেখায়নি শেষতক অস্থিত্ব সংকটেও পড়েছে। আর পড়বেনা কেন, আমরা এমন এক জাতি যারা গাভীর দুধ খাই, তারপর গাভীর বাছুর খাই এবং সবশেষে গাভীটিও জবাই করে খেয়ে ফেলি। অথচ অন্তত এই গাভীটি জীবিত থাকলে আর না হোক বছরান্তে আবার দুধ এবং বাছুর পাওয়া যেতো। এভাবে আমরা সব সম্ভাবনাকে শেষ করে দিয়েই নিজে সাধু সাজি। আর এই সাধুর দলে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, সমাজবিদ, সুশীল এবং বুদ্ধির ফেরিওয়ালা সব তেলবাজ-টাউট-বাটপার-বদমায়েশ-ঘুষখোর-চোর-ডাকাত সবই। এ যেনো পাপিষ্ট উৎপাদনের সেরা এক খণ্ড জমিন সাথে সেরা কারখানা। নাহয় সামনে যে যাই বলিনা কেনো পেছনে কিন্তু এই আমরাই এদের স্বীকৃতি দেই সমীহ করি। এতে এসব পাপ-পঙ্কিলতার সাথে সাথে পাপিষ্ঠদেরকেও বাঁচিয়ে রাখি।
নাহয় অন্তত নিজের স্বার্থটাওতো রক্ষা করার কথা। কিন্তু তাও তারা করেনা উল্টো ডালে বসে ডাল কাটে। এতে তাদের নিজেদেরও শেষ রক্ষা হয়না। যেজন্য এসব চরিত্রগুলো গায়ের কাপড় খুলে ফেললেও ভাবে হোক না তাতে কি। নাহয় শিক্ষার জন্য কথা বলার আর কেউ না থাকুক শিক্ষক-ছাত্র এবং অভিভাবকরাওতো চিৎকার করতে পারতো, পারতো রাস্তায় নামতে। অথচ এই তারাই নামে রাজনীতির জন্য কিংবা অন্যের জন্য। ঠিক তেমনি সুশীল ও সুধীজন এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবি তথা বুদ্ধির ফেরিওয়ালারাও একটু নসিহত করতে পারতো, কিন্তু তা করবেনা। করবে দলবাজি, তেলবাজি এবং লোকদেখানো নীতিনৈতিকতার বেসাতি।
অপরদিকে পর্যটনও ঐ একই রকম ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার। নাহয় যে পর্যটন নিয়ে গোটা বিশ্ব এখন ব্যতিব্যস্ত সেই পর্যটন কি তা আমরা এই তিপান্ন বছরেও বুঝতে পারিনি, চিনতেও পারিনি। এমন কি হয়তো কোন চেষ্টাও করিনি। অথচ এই পর্যটন শিল্পে আমাদের এত সম্ভাবনা রয়েছে যা চিন্তাও করা যায়না। কেন না পর্যটন উন্নয়নের জন্য যে দু’টি মৌলিক উপাদান অর্থাৎ পর্যটন সম্পদ এবং মানব সম্পদ দরকার তার দু’টোই আল্লাহ পাক আমাদের দুহাত খুলে দিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমরা এমন অকর্মণ্য ও অন্ধ যে এই বিশাল-বিস্তৃত সম্পদগুলোকেও জেনেশুনে কাজে লাগাতে পারছিনা বা লাগাচ্ছিনা।
সরকার, রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিবিদ, সমাজচিন্তক, পর্যটনের অংশীজন, গণমাধ্যম কেউই এই ব্যাপারে আন্তরিকতো নয়ই উপরন্তু এটিকে ঠিকই সুযোগমত কাজে লাগায় আর অপরদিকে পর্যটন বদনাম কুড়ায়। নাহয় যেখানে আজ পর্যন্ত পর্যটনের তেমন কোন বাজেট বরাদ্দই নেই সেখানে পর্যটনের মন্ত্রী-সচিবরা একের পর এক জেলে যায় কিভাবে। এভাবে এই ধরপাকড় যদি আরো নীচের দিকে আসে তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে কে জানে। অথচ পর্যটন মন্ত্রণালয়, উজির, আমলা-কামলা, বোর্ড, করপোরেশন কত কি আছে নাই শুধু পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন। আবার বেসরকারি খাতে মাশাল্লাহ ডজন-ডজন সমিতি, শতাধিক নেতা-পেতা সাথে তেলবাজ মতলববাজের উপস্থিতি রয়েছ এবং তারা নিজেদের স্বার্থটা ঠিকই বুঝে। শুধু বুঝেনা পর্যটনেরও যে একটা স্বার্থ রয়েছে যা রক্ষা করা না গেলে শুধু দেশেরই নয় নিজেদেরও স্বার্থ এবং বিচরণ ক্ষেত্র সীমিত হয়ে আসবে।
আবার আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতায় আসলেই পর্যটন পাগল হয়ে উঠে শুধু নিজেদের স্বার্থে। তারপর কেউ পর্যটনকে মনেই রাখেনা। কারণ, পর্যটন শুধু তাদের স্বার্থের খাতায় আছে কিন্তু এটিকে যে বাঁচাবেন কিংবা এর উন্নয়নের জন্য আন্তরিকতার সাথে কিছু করবেন তাতেও তারা অনুপস্থিত; এমনকি তাদের কোন সদিচ্ছাও নেই। যেজন্য আজ পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দলের কারো মেনিফেষ্টো বা ইশতেহারে পর্যটনের কোন নাম গন্ধও নেই।
অন্যদিকে আমাদের অর্থনীতিবিদরাও নাকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্ব তোলপাড় করছেন। অথচ তাদের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের তালিকায় নিজ দেশের পর্যটন কখনো নেই এবং তারা এনিয়ে কোন কথাও বলেনা। তারা শুধু গদিনশীন সরকারের চারপাশে থেকে শোরগোল করে এবং নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। কিন্তু যদি তারা দেশের তথা অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে তাদের ভিশন, মিশন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের ছক আঁকতেন তাহলে কিন্তু পর্যটন ঠিকই তার জায়গা করে নিতে পারতো।
কেন না বিশ্বে পর্যটন এখন একক সর্ববৃহৎ শিল্প। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, দারিদ্রদূরীকণ, সংস্কৃতি সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নে পর্যটনের কোন বিকল্প নেই। বিশ্বের মোট কর্মসংস্থানের শতকরা দশভাগ তার দখলে। আবার ‘ডাবলুটিটিসি’ এর দেয়া তথ্য মতে নতুন কর্মসংস্থানের দিক থেকে শতকরা চারজনই রয়েছেন এই পর্যটন শিল্পে। তাইতো সর্বরোগের এমন দাওয়াই নিয়ে গোটা বিশ্ব এখন ব্যতিব্যস্ত। আর আমাদের অর্থনীতিবিদরা গোটা বিশ্বকে সূত্র কিংবা সংজ্ঞা দিচ্ছেন কিন্তু নিজেদের অপার সম্ভাবনা কি তা নিয়ে কিছু বলছেন না। তার সাথে পর্যটন গুরু এবং পন্ডিতরাও দেশে-বিদেশে বিচরণ করছেন, বড় বড় ডিগ্রী নিচ্ছেন কিন্তু দেশের ভিতরে কেনো জানি খেই হারিয়ে ফেলছেন।
বড় আশা ছিলো যেহেতু এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান একজন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং আমাদের গর্ব সেহেতু এবার হয়তো পর্যটন বিবেচনায় আসতে পারে। সংস্কার হোক আর যেভাবেই হোক এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর দিকনির্দেশনাটুকু অন্তত তিনি দিবেন; এমনকি নিজে হয়তো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিতে পারেন। কেন না পর্যটন মন্ত্রণালয় ছিলো তাঁরই কাছে। কিন্তু না সেই আশার গুড়ে বালি এবং ভরসারও পাত্র খালি। অবশ্য বলাবলি ও লেখালেখি করেও এই শিল্পের কাউকে না পেয়ে এক সময় নিজেই সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত লিখে সরাসরি উনার ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু না সেটিও হয়তো ঠিকানা হারিয়েছে নয়তো অবহেলার পাত্রে জায়গা করে নিয়েছে। এমন কি সর্বশেষ বিশ্বখ্যাতদের ব্যবহার করে বিনিয়োগের জন্য এত বড় যে জলসার ইন্তেজাম করা হলো সেখানেও পর্যটন কেতাবেতো নেইই এমনকি বয়ানেও নেই।
শেষ কথা, যে যাই করিনা কেনো মনে রাখতে হবে, গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স ফুরাবে যেহেতু অচিরেই মানুষের জায়গা মেশিন দখলে নেবে। তাই দারিদ্রতা ও বেকারত্ব সামাল দেয়ার দাওয়াই বলি অথবা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা যাই বলিনা কেন দেশ ও জাতির জন্য শুধু বর্তমান নয় দীর্ঘমেয়াদেও এই শিক্ষা এবং পর্যটনই সর্বোত্তম ও শেষ ভরসা। কারণ, সব হারিয়ে যায় শিক্ষা হারিয়ে যায়না, পর্যটন সম্পদ হারিয়ে যায়না এবং এগুলো ফুরায়ও না। যেজন্য জাপানীরা যখন আমাদের চেয়েও আরো বেশি অধঃপতনে চলে যায় তখন বাঁচার জন্য ঔষধ হিসেবে এই শিক্ষাকেই গ্রহণ করে। ধনী দেশগুলোর কাছে থেকে মানুষ বাঁচানোর কথা বলে ঋণ এনে তা শিক্ষায় বিনিয়োগ করে। যা তাদেরকে দুনিয়ার শেষ উন্নত দেশের স্থান ও মর্যাদা এনে দিয়েছে। তেমনি থাইল্যাণ্ড আর কোন উপায় না পেয়ে নিজের পর্যটন সম্পদ ও মানব সম্পদ ব্যবহার করে আজ সে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা তা পারছিনা হয় গভীর ষঢ়যন্ত্রের শিকার হয়ে নাহয় দেশপ্রেম এবং যথাযথ জ্ঞানের অভাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি এই উপব্দি আমাদের মধ্যে আসবে এবং সে মোতাবেক কাজ করবো তত তাড়াতাড়ি ভুল সিদ্ধান্তে ভুল পথে হাঁটা বন্ধ হবে। তার সাথে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে এমনকি সমৃদ্ধিও আসবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)।