শাহাবুদ্দিন শুভ :: সে ছিল কচি ফুলের মতো, সদ্য ফুটতে চাওয়া একটা কুঁড়ি। পৃথিবীর রঙিন স্বপ্নগুলো তখনো চোখের পাতায় লেগে ছিল। বাবা-মায়ের হাসিতে, বন্ধুদের গল্পে, খোলা আকাশের নিচে সে স্বপ্ন দেখতো—একদিন সে হবে বড়, একদিন তার জীবনেও আসবে রোদের ঝলক। অথচ এই ছোট্ট শিশুটি তার বোনের শ্বশুরবাড়িতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আজ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে।
কতটুকু কষ্ট সহ্য করেছে আট বছর বয়সী ছোট্ট মেয়েটি? ছয়ই আগস্ট বেলা ১১টার কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে অচেতন অবস্থায় মাগুরা আড়াইশ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে আসেন এক নারী। পরে জানা যায়, ওই নারী তার বোনের শাশুড়ি। এরপর খবর পেয়ে শিশুটির মা হাসপাতালে আসেন। তখন হাসপাতালে চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শিশুটির গলায় দাগ ও শরীরে বেশ কিছু জায়গায় আঁচড় দেখতে পান। চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে পুলিশ জানায়, শিশুটির যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো।
অবস্থা ভালো নয় দেখে তখনই মাগুরা হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে শিশুটিকে নেয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে সেদিনই সন্ধ্যায় তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শিশুটিকে ঢাকায় আনার পরপরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছিলেন, তার শারীরিক অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’। সাতই মার্চ রাত থেকে শিশুটিকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। শিশুটির চিকিৎসায় একটি মেডিক্যাল বোর্ডও কাজ শুরু করে। পরে আট মার্চ তাকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়।
আট মার্চ শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সিএমএইচ-এ নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার চার বার এবং আজ সকাল থেকে আরও তিন বার তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে বলেও জানানো হয়।
প্রায় আট দিন হাসপাতালে শারীরিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে যায় মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুটি। আজই সন্ধ্যায় তার মরদেহ দাফনের জন্য সামরিক হেলিকপ্টারে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে সরাসরি মাগুরায় নেওয়া হয় বলে তার পরিবার জানিয়েছে।
বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে গত পাঁচই মার্চ সে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। আজ বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে শিশুটির মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এতে বলা হয়, দুপুর একটার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
কিন্তু এই নিষ্ঠুর সমাজ তাকে সেই স্বপ্ন দেখার সুযোগ দেয়নি। কিছু নরপিশাচ তার ছোট্ট জীবনটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিলো। তার চিৎকার, তার আকুতি—সব হারিয়ে গেলো অন্ধকারের গহ্বরে। কেউ শুনলো না, কেউ এগিয়ে এলো না। সে চেয়েছিল বাঁচতে, মরতে নয়। কিন্তু সমাজের নির্মমতা তাকে বাঁচতে দিলো না। শেষমেশ হাসপাতালের শীতল বিছানায় নিথর পড়ে রইলো সে। তার স্বপ্নগুলোও নিথর হয়ে গেলো, তার হাসির ঝিলিক হারিয়ে গেলো চিরতরে।
এ কেমন সমাজ? যেখানে একটা নিষ্পাপ মেয়ে নিরাপদ নয়? যেখানে ন্যায়বিচার শব্দটা কেবল কাগজে লেখা থাকে? এই মৃত্যুর দায় আমাদের সবার। আমরা চেয়েছিলাম সে বেঁচে থাকুক, কিন্তু আমরা পারলাম না তাকে বাঁচাতে। আজ আকাশটা হয়তো একটু বেশি মেঘলা, বাতাসটা ভারী, চারপাশে কেবল শোকের সুর। কিন্তু তার অশ্রুভেজা চোখ যেনো আজও প্রশ্ন করছে—”আমার দোষ কি ছিল?”
সারাদেশের মানুষ এই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। সবাই চাচ্ছেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আদৌ কি আছিয়ার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে? নাকি অন্য ধর্ষণ মামলার মতো এটাও হারিয়ে যাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে? আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে আমরা কি পারি না আমাদের সন্তানদের জন্য একটি বাসযোগ্য ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে? যার আলো-বাতাসে নিরাপদে ঘুরে বেড়াবে আমাদের সন্তানেরা?
আমরা কি পারবো একদিন সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে? নাকি আরেকটা নীল স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখতে হবে?
ahmedshuvo@gmail.com