গোলাম সোবহান চৌধুরী :: “বলিতেছিলাম সংস্কৃতির মূল উৎসের কথা। সংস্কৃতির জন্ম-প্রেরণা যেখান হইতেই হউক না কেন, সংস্কৃতির উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসার পরিবেশ নিরপেক্ষ নহে। এই পরিবেশের প্রধান উপাদান ঐতিহ্য। ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার অর্থ ভিত্তিকে অস্বীকার করা। মাটি ভিত্তি করিয়া তাজমহল দাঁড়াইয়া আছে। সেই মাটির গুরুত্ব অনেকখানি। ইহা ছাড়া তাজমহল তৈরি সম্ভব ছিল না। তেমনি ঐতিহ্য-সম্পর্ক-বিহীন-সংস্কৃতি-সাধনাও অসম্ভব। ঐতিহ্যে যাহা কিছু ভাল তাহার অনুসরণ এবং যাহা কিছু নিন্দনীয়, তাহার বর্জনেই নূতন জীবনাদর্শের সন্ধান মিলে। সংস্কৃতির রূপান্তরও এইভাবেই ঘটে। অগ্রগতিও আসে এই পথে।”
কথাগুলো আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ এর।
মুসলমানী বাঙলা” কি জিনিস, অভিভাষণ থেকে নেয়েছি।
আব্দুল করিম বাঙ্গালীদের, এ ভূখন্ডের মানুষজনের ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে নিজ ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিষয়ে উদাসীনতা, বিরাগ ও আত্নচেতনার অভাব অবলোকন করে খেদ প্রকাশ করেছেন । একই সাথে তাঁর নিকট এও পরিলক্ষিত হয়েছে যে, নিজেদের প্রাচীন সম্পদ ও মাটির রসসিক্ত মৌলিক অর্জনসমূহ তথা ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বিস্তার ও বিকাশের ব্যাপারে বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা নিষ্ক্রিয় অসচলতা আছে; সামাজিক উদ্যোগহীনতা সমন্ধে সুধীজনের তিনি বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ইতিহাস ও শেকড় চ্যুত জীবন প্রাণ-রসহীন হয়, তা সজীব জীবনের ও সমাজ মননের বিকাশ ও বিস্তার প্রকৃত অর্থে ব্যাহত করে; তিনি বারংবার তা উল্লেখ করেছেন এবং এও বলেছেন যে, আত্মসচেতনতা-ইতিহাস চেতনা ও সংস্কৃতি রহিত প্রাণ অপূর্ণ থাকে তাই, ইতিহাস সংলগ্ন প্রাণবান সংস্কৃতি-ভাষা-কৃষ্টি-ঐতিহ্য লালন ও সংরক্ষণ খুবই জরুরী। এর চর্চার মধ্যদিয়ে জাতি প্রাণবান হয়ে ওঠে, দৃঢ় শিকড়ের উপর দাঁড়ায়।
এমসি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও বিশিষ্ট কলামিস্ট শেখর ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ঐতিহ্য নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর ও সহজবোধ্য কথা বলেছেন ইংরেজ কবি টি এস ইলিয়ট। বৃক্ষের সাথে তিনি তুলনা করেছেন ঐতিহ্যকে। বৃক্ষের সমস্ত শক্তি যেমন শেকড়ে সঞ্চিত থাকে, একটি সমাজেরও সকল নান্দনিক সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে থাকে ঐতিহ্যের মধ্যে। বৃক্ষ যেমন শেকড়চ্যুত হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না, সমাজও ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে পথ হারা হয়ে পড়ে। শুধু পথকেই হারায় না, ঐতিহ্য হারিয়ে সভ্যতার পথ থেকেও দূরে সরে আসে। আমরা মাটির উপর থেকে বৃক্ষকে নানা রূপে দেখতে পাই। পত্র-পল্লবে সুশোভিত। মাটির নিচে শেকড়ের সাহায্যে প্রাণরস সংগ্রহ করে বৃক্ষ সুশোভিত হওয়ার সুযোগ পায়। বৃক্ষের পত্র, পল্লব, ডালপালা দৃশ্যমান থাকে, তাই আমাদের প্রখর দৃষ্টি থাকে বৃক্ষের বহিরাঙ্গের দিকে। শেকড়চ্যুত হলে প্রাণরস সঞ্চয় করতে না পেরে ধীরে ধীরে প্রাণহীন হয়ে পড়ে বৃক্ষ। একটি সমাজ ততক্ষণই নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করতে পারে যতক্ষণ গৌরবময় ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে গতিশীল থাকে। ঐতিহ্য একটি জাতির প্রবহমান জীবনধারার গৌরবময় অনুভূতি, যা দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদেরকে সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত বোধ করে। ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া অনেকটা রিলে রেসের মতো। রিলে রেসে যেমন হাতের বাটন একজনের কাছ থেকে আর একজনের হাতে হস্তান্তর করতে হয়, ঐতিহ্যকেও একইভাবে পূর্ব প্রজন্মকে উত্তর প্রজন্মের কাছে সযত্নে হস্তান্তর করতে হয়। কাজটি পূর্ব প্রজন্মকেই করতে হয়। নতুন প্রজন্ম যাতে নিজের পূর্বপুরুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। এতে করে আত্মপরিচয়ের সংকট দূরীভূত হয়ে আদর্শ জাতিসত্তার বিনির্মাণ সম্ভব হয়। এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে নব প্রজন্ম তাদের গর্ব এবং অহংকারের অতীত ঐতিহ্য বিস্মৃত হবে।’
কেন ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এত উতলা হয়ে ওঠা, কেন বারবার বলতে হচ্ছে ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা জরুরী; কেন এমন কোন বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হলো যে একটা অঞ্চলের মানুষকে তাদের বিশেষ স্মৃতি, গৌরবের অতীত ইতিহাস, অগ্রজদের কর্মযজ্ঞে সৃষ্ট উজ্জ্বল্যের স্বাক্ষর, সমৃদ্ধি-সভ্যতার পথে অগ্রগতির চিহ্ন এবং ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য ব্যাকুল করে তোলে । এসব জানা-বুঝাটা জরুরী আছে। যখন দেখি দেখতে দেখতে সব হারাতে বসেছি, কিছুই আটকানো যাচ্ছেনা, যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, ঠিক তখন-ই আমরা বারবার বলি রক্ষা করতে হবে, সংরক্ষণ করা হোক। চলমান চিত্র হলো রাষ্ট্র-সমাজ যখন গৌরবের ইতিহাস সংরক্ষণে অনিহা দেখায় তখন একেবারে আত্নপরিচয়ের সংকটের সম্ভাবনা তৈরির প্রশ্ন সামনে চলে আসে। কি করেছি, কি করা হয়েছে এবং কি ছিল বা কি আমাদের ছিল না। আহা ! সভ্য জগতের ইতিহাসে সভ্যতা বিনির্মাণে কোন অঞ্চলের জনসমাজের সমষ্টিক কন্টিভিউশনের ইতিহাস ম্যাটার করে। একটা সুমহান ঐতিহ্য বিনির্মিত হয়েছে গোটা সমাজের প্রাণরস ও সৃষ্টিশীলতার উপরে, সে কৃষ্টি বিনির্মাণে অংশীদারিত্ব সেই জনপদের সম্মান বৃদ্ধি করে। তার উন্নত চিত্তবৃত্তির পরিচয় উজ্জ্বল হয়। সে সমৃদ্ধির গৌরব বাঁচিয়ে রাখার নাগরিক কর্তব্য বর্তায় উত্তরপুরুষদের উপর।
আমাদের পূর্বপুরুষদের উন্নতচিত্ত ও উন্নত চিন্তার স্বাক্ষর মানুষ হিসেবে আরো দায়িত্বশীল হতে বলে এবং আমাদের কর্তব্য নিষ্ট হতে শেখায়। তার ধ্বংস আমাদের মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধের শেষ ডেকে আনার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। আত্নপরিচয়ের সংকটের বিপদের মুখে পড়ে গোটা জনপদ। অবহেলার নয়। একটা চ্যালেঞ্জ।
সিলেটের ঐতিহ্য-কৃষ্টি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্নতার নানা কারণের মধ্যে অন্যতম হলো শৈশব হারানোর মতো করে এই নগরী সব হারাতে বসছে। এই শহরটাকে আমরা যেমন দেখেছি, এই মহানগরের যে সৌন্দর্য, এর নান্দনিক প্রকৃতি ও তার বিন্যাস, ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে এমন স্থাপত্য সৃষ্টি, সবকিছু নষ্ট হয়ে যেতে দেখছি। অনেক কিছুই আমরা ধ্বংস করেছি। এটা আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, আমাদের মধ্যে এক ধরনের আত্নসংকট, এক ধরনের হাহাকার, ব্যার্থতার বোধ তৈরি করেছে যেমন সত্যি; তেমনি খড়কুটু আঁকড়ে ধরার মতো অবশিষ্টটুকু রক্ষার তীব্র ব্যাকুলতা জাগ্রত করে আমাদেরকে আরো সচেতন ও কর্তব্যনিষ্ট এবং দায়িত্বশীল করে তোলে। কিছু করতে না পারার, প্রতিরোধ গড়তে না পারার, টিকিয়ে রাখতে না পারার পরাজয় বোধ আমাদের আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে গড়ে তোলে। সংগ্রামশীলতা শেখায়।
দেশ-বিদেশ হতে সিলেটে মানুষ কেন ছুটে আসেন, ছুটে আসেন সিলেটের ভূ-প্রকৃতির অপরূপতা ও নান্দনিকতা তাদেরকে টানে, তার প্রকৃতির বৈচিত্র্য মানুষকে মোহিত করে। যদি আমাদের কৃষ্টির স্মৃতিবহ চিহ্ন মানুষ অবলোকন করে, তাহলে এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সন্ধানে মানুষ ব্যাপৃত হবে এবং সমৃদ্ধ জনপদের অতীত কৃষ্টির গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ অবলোকন করে সভ্যতার অগ্রগতির পথে এ জনপদের মানুষের অবদানসমূহের জন্য সভ্যজগতে আমাদের সম্মান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।
আমরা কি আমাদের গৌরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে পারছি, এ প্রশ্ন থেকে যায়।
এই জনপদের গড়ে ওঠার স্তরে স্তরে শতশত বছরে সৃষ্ট সভ্যতার সম্পদ লালন করা, সভ্য দুনিয়ার কাছে উপস্থাপন করা এই জনপদের সন্তান হিসেবে আমাদের কর্তব্য । কালের খেলায় বহু কিছু বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শতবছর আগে এখানে আমাদের কৃতি হলো বৃহত্তর পরিসরে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, বড় পরিসরে উচ্চ শিক্ষার যাত্রা শুরু করার অমন একটা ইতিহাস কান্ড সংগঠন, এতো বড় অর্জন, তা হলো এখানকার মানুষের উন্নত চিন্তা-উন্নত রুচি-উন্নত ভাবনার নিদর্শন, বড় চিত্তবৃত্তির পরিচয়ের বাহন । তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি, কৃতবিদ্য মানুষের পদচারনা, প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর উন্নত নিদর্শন মিলে গোটা কলেজ একটা বিহৎ ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে।
এখন আসলো কথা মুরারিচাঁদ কলেজের দুটি প্রাচীন ভবন নিয়ে। স্হানিয় ভাবে আসাম প্যাটার্ন বা কোথাও পরিচিত বাংলা প্যাটার্ন নামে। এগুলো আসলে কি এখানে?
বাড়িগুলো পরিবেশবান্ধব ও আরামপ্রদ। অবাধে বায়ু চলাচলের কারণে সেগুলো সিলেটির বৈরী আবহাওয়ায়ও অধিক পরিমাণ বৃষ্টিজনিত কারণে স্যাসসেতে হওয়া থেকে মুক্ত। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের মহা ভূমিকম্পের পর দুর্যোগসহনীয় ও প্রতিরোধক হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। অনন্য ধারার সিলেটি স্থাপত্য ঐতিহ্যের ঘরবাড়ি বাংলাদেশের স্থাপত্য বিদ্যায় আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
১৮২৪ সালে ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধে বর্মার পরাজয়ের পর আসামের মালিকানা ইংরেজদের কাছে চলে যায়। তারা দেশ শাসন করার জন্য তথায় প্রশাসনিক ও আবাসিক অবকাঠামো নির্মাণে উদ্যোগ নেয়। ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক প্রতিকুলতার কথা বিবেচনা করে স্থানীয় উপকরণে নতুন স্থাপত্যধারার প্রচলন করে। যা কালের প্রবাহে শতশত বৎসর উৎরে যায়। সিলেট আসামের বৃহত্তর অংশভুক্ত হওয়ায় সিলেটের গৃহনির্মাণরীতিতে নব ধারার প্রযুক্তি ‘আসাম টাইপ বাড়িঘর’ প্রাধান্য পায়। সর্বস্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। বিত্তশালীরা ব্যাপকভাবে এ রীতিতে বাড়িঘর নির্মাণ করতে থাকেন। ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে টিকে থাকা ঘরবাড়িগুলো সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় রাতারাতি বাড়ি নির্মাণ স্থাপত্যে যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করে। ১৯২০-১৯৬০ সালে এই স্থাপত্যরীতি ‘বাংলা ব্যাটন স্টাইল’ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর মূল কারণ হচ্ছে বাঁশ ও কাঠের ব্যাটন ব্যবহার। এই তথ্যটুকু পাচ্ছি আমরা জার্মান প্রবাসী সিলেটি সামছুল মজিদ চৌধুরী সাকী Saki Choudhury রচিত ‘আসাম টাইম ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট’ নামীয় গ্রন্থ থেকে।
এমসি কলেজে প্রাচীন ও অপূর্ব স্থাপত্য শৈলীর আসাম প্যাটার্নের ভবনঃ
কলেজের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, এমসি কলেজ কে কেন্দ্রকরে অক্সফোর্ডের আদলে একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ভাবনা ছিল তৎকালীন সরকারের। তাইতো ভূ-প্রকৃতি অনুসারে কলেজ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা ও সাজানো হয়েছিল। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের আর্টস ভবন, বৃটিশ ও আসামী স্থাপত্য মিশেলে আসাম প্যাটার্নের ভবন, ইউরোপিয়ান ধাছের লাইব্রেরি ভবন, বিশাল কলেবরের দীঘি, ক্যাম্পাস।
অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ স্যার রচিত “মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিকথা” গ্রন্থ হতে আমরা জানতে পারি যে, ‘১৯১৭ সালে আসামের চীফ কমিশনার স্যার এন ডি বিটসন বেল কলেজের ব্যাপারে নতুন উদ্যোগ নেন এবং কলেজের জন্য বর্তমান জায়গা নির্ধারণ করেন। সরকারী ভাবে ১১২ একর ভূমির উপর ১৯২১-১৯২৫ সালের মধ্যে অনেক গুলো নান্দনিক নকশায় ভবন তৈরি হয় যা ওই সময়কার স্থাপত্য কলার নিদর্শন বহন করে আসছে। স্থাপত্যকলার নিজস্ব একটি ধারা আছে। স্থাপত্য কলার সংস্কৃতিটি তার ঐতিহ্য গত বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের আধুনিক স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে।
সিলেটের সরকারী মুরারিচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ঐতিহ্যবাহী আসাম প্যাটার্নের ভবন দুটি শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চা অনুশীলনের ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এই ভবনসমূহের অনন্য নির্মাণশেলী স্থাপত্য কলায় এতদ অঞ্চলে এক নবধারার প্রবর্তনও বটে। বর্তমানে মুরারিচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মোট ভূমির পরিমাণ ১৪৪ একর। তন্মধ্যে মাত্র ২ একর ভূমির উপর আসাম প্যাটার্নের ভবনদুটি অবস্থিত। এছাড়াও ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত কলা ভবন ও লাইব্রেরি ভবনও ইতিমধ্যে শতবর্ষী। এই অনন্য নির্মাণশৈলীর ভবন সমূহ ক্যাম্পাসের নান্দনিকতার অবিচ্ছেদ অংশ। এই প্রাচীন ভবনসমূহের অবয়ব ছাড়া নান্দনিক মুরারিচাঁদ কলেজ ক্যাম্পাস কল্পনাও করা যায়।
আসাম প্যাটার্নের ভবনদুটি ঘিরে রয়েছে খ্যাতিমান ব্যাক্তিবর্গের বহু স্মৃতি। কলেজ ম্যাগাজিন ও অন্যান্য সূত্র থেকে তার সমন্ধে জানা যায় ১৯২১-১৯২৫ খৃষ্টাব্দের এর মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ১৯২৬ সাথে ভবনদুটিতে বিজ্ঞান ক্লাস শুরু হয়। আসাম প্যাটার্ন ভবনগুলো সিলেট তথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ।
আধুনিকায়ন এখন বৈশ্বিক ট্রেন্ড (Trend)। পরির্বতন-বিবর্তন জগতের নিয়ম। তারপরও ঐতিহাসিক কৃষ্টি সংস্কৃতি লালন করেই মানুষ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের ঐতিহ্যবাহী আসাম প্যাটার্নের ভবন দুটিসহ অন্যান্য ভবনসমূহ এ অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলার একটি প্রাচীন সংস্কৃতির প্রত্ননিদর্শন। আগামী প্রজন্মের কাছে সভ্যতার ক্রম বিকাশের ধারার অনুশীলনের একটি পাঠ হিসাবে এই ভবনদুটি একদিন অন্তর্ভুক্ত হবে।
শিল্পী হাশেম খান বলেছিলেন, “একটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্ন সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসজিদ-মন্দির-প্রাসাদসহ বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন থেকেছে। এটা খুবই পীড়াদায়ক। এই নির্লিপ্ততা চলতে থাকলে অযত্ন-অবহেলা আর দখল-দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে অদূর ভবিষ্যতেই হারিয়ে যাবে কালের সাক্ষী আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক স্থাপনাগুলো।”
সিলেটের নির্মাণশৈলীতে ঐতিহ্য “আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ” এর নিদর্শন এমসি কলেজের প্রাচীন ভবনগুলো সংরক্ষণ করাও জরুরী ও ঐতিহাসিক কর্তব্য। সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কলেজের আসাম প্যাটার্নের ভবন দুটি ঐতিহাসিক প্রত্ননিদর্শন বিবেচনায় নিয়ে সংস্কার, সংরক্ষণ কিংবা একই স্থাপত্যশৈলী অক্ষুন রেখে পুঃনির্মান করা উচিত। স্থাপত্য বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, এখনও পুরাতন ভবনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অনেকগুলো উপায় আছে।
দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব এবং তা প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে প্রবাহমান রাখার আশু কর্তব্য আমাদের উপর ইতিহাস ন্যস্ত করেছে। কেননা, একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের শেকড় পোঁতা থাকে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে। কাজেই, মুরারিয়ান হিসাবে আমরা নবীন, তরুণ, প্রবীণ সকলেই সেই অর্জিত ও গর্বিত ঐতিহ্য ও আবেগের উত্তরাধিকারী। আসুন, সকলে সম্মিলিত ভাবে আমাদের গৌরবে উজ্জ্বল ঐতিহ্য মুরারিচাঁদ কলেজের ঐতিহ্যবাহী ভবনসমূহ সংরক্ষণ ও রক্ষা করি এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পূর্বপুরুষের কৃতিত্ব, ত্যাগ, অর্জন ও উন্নত আকাঙ্খার বার্তা রেখে যাই।
প্রচ্ছদ রচনাঃ মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ, মুরারিচাঁদ কলেজ ত্রৈমাসিক সাময়িকী-“জাগরণ” । বর্ষ-১২• সংখ্যা-২০ ।
লেখকঃ গোলাম সোবহান চৌধুরী। প্রাক্তন ছাত্র, এমসি কলেজ,সিলেট। অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট। ট্রাস্টি, পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট,সিলেট)