অ্যাডভোকেট শফিকুল হক :: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ আন্দোলন কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক দৃষ্টান্তমূলক গণআন্দোলনে রূপ নেয়, যার পরিণতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারায় এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
ছাত্রদের আন্দোলন থেকে জনতার বিপ্লব : বিপ্লবের সূচনা ঘটে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে, যারা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাজপথে নামে। প্রথমদিকে আন্দোলনটি শুধুই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, খুব দ্রুতই সাধারণ জনগণ এর প্রতি সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে নেমে আসে। দাবির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কেবল কোটা সংস্কার নয়, বরং পুরো সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান। এর ফলে আন্দোলনটি একটি গণজাগরণে রূপ নেয়।
রাজনৈতিক দলের ভূমিকা : যদিও শুরুতে কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি আন্দোলনে অংশ নেয়নি, পরে কিছু দল সতর্ক বিবৃতির মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানায়। তবুও, আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ।
রক্তক্ষয়ী বিপ্লব : এই বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে গিয়ে শত শত ছাত্র-জনতা তাদের প্রাণ বিসর্জন দেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এসব বলিদানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের পথ সুগম হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হন।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা : সরকার পতনের পর এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। কে হাল ধরবে এই প্রশ্নে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন প্রস্তাব দিলেও, সর্বসম্মতিক্রমে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তবে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি বিপ্লব চলাকালীন দেশেই ছিলেন না এবং এ আন্দোলনে তাঁর সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না।
আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যতের পথ : অন্তর্বর্তী সরকার শিগগিরই একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দেয়। দেশ এখন অপেক্ষা করছে একটি নতুন দিগন্তের, যেখানে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে—এই প্রত্যাশা নিয়েই মানুষ আগামীর দিকে চায়।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ-গ্রহণ নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। অনেকের মতে, এই বিপ্লব-পরবর্তী সরকার গঠনের সময় প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে শপথ-গ্রহণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হওয়া উচিত ছিল। এটি শুধুমাত্র সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, সে সময়কার অভিজ্ঞতার অভাব, সময়ের সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ ধরনের প্রটোকল অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি।
ড. ইউনূস ও দেশ পরিচালনার নতুন ধারা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে বিরোধী দলগুলো মাঝে মাঝে সমালোচনামূলক মন্তব্য করলেও, বাস্তবতা হলো—তিনি বিপ্লব চলাকালীন দেশে ছিলেন না এবং সরাসরি কোনো রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর সরকার পরিচালনার ধরন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, তিনি কোনো বহির্বিশ্বের বিশেষ করে ভারতের প্রভাবমুক্ত একটি প্রশাসন গঠনের চেষ্টা করছেন।
ড. ইউনূস যেসব সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা অনেকাংশেই তাঁর দৃঢ় নেতৃত্ব এবং স্বাধীন চেতনার প্রমাণ। তিনি বারবার দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজের স্বার্থে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ভারতের প্রভাব: বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে এমন কোনো সরকার ছিল না যা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভারতের প্রভাবমুক্ত ছিল। এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চে রেখে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই নীতি আগামী দিনের জন্য একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র সরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা কোনো প্রকার বিদেশি প্রভাব ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। এই সরকার এবং এর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রমাণ করেছেন, সৎ নেতৃত্ব ও সাহসিকতা থাকলে রাজনীতি ছাড়াও দেশ পরিচালনায় সফলতা সম্ভব।
বিশ্বখ্যাত এই অর্থনীতিবিদ যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন, তথাপি স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন সফল রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার নেতৃত্বে জাতি নতুন করে আশা দেখেছে—স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা ও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে ড. ইউনূস : বহুজনের মতে, ড. ইউনূস ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন। যদি আগামী নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দল তাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়, তবে তা কেবল দেশের মর্যাদা বাড়াবে না, বরং একজন নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকবেন। তার ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক সংযোগ—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশের সঙ্গে—বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
নিরপেক্ষতা ও নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা : যদিও ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি, তবে বিশ্বাস করি তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত ও নিরপেক্ষ থাকবেন। তবে এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের উপর এবং সর্বোপরি ড. ইউনূস নিজে এই প্রস্তাব গ্রহণ করবেন কি না, তার উপর। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়—এই পদ গ্রহণ করলে তার চেয়ে বেশি লাভবান হবেন সরকার এবং সমগ্র বাংলাদেশ।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশ্বাস সত্ত্বেও যে আগামী নির্বাচন স্বাধীন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে—রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমেই অধৈর্য ও ব্যাকুল হয়ে উঠছে। তারা এমন এক নির্বাচনের দিকে এগোতে চাইছে, যেখানে এখনো প্রয়োজনীয় নির্বাচন-সংস্কার সম্পন্ন হয়নি—যা কিনা দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম মূল দাবি ও প্রত্যাশা।
তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ ও সম্ভাব্য সমঝোতা : সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরের সময় ড. ইউনূস বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। ঐ সাক্ষাতে উভয়ের মধ্যে আলোচনা হয় যে, নির্দিষ্ট কিছু আনুষ্ঠানিকতা ও সংস্কার যদি সম্পন্ন করা যায়, তবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ তৈরি হতে পারে।
যদিও ইতিমধ্যেই ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে নির্বাচন আয়োজনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে, তবে অনেকের মতে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন হলে তা দেশের জন্য আরও ফলপ্রসূ হতো।
রূপান্তরের বিস্ময়কর অগ্রগতি : অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, স্বল্প সময়ে—এক বছরেরও কম সময়ে—ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের প্রশাসন, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে অভূতপূর্ব রূপান্তর সাধিত হয়েছে। তাঁর সাহসিকতা, দুর্নীতিমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশপ্রেমের দ্বারা প্রভাবিত একটি প্রশাসন দেশ পরিচালনার নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে।
যুক্তরাজ্য সফর ও প্রবাসীদের গর্ব : ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর শুধুমাত্র একটি সম্মাননা গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা ছিল না; বরং এটি হয়ে উঠেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এক গর্বের অধ্যায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য তিনি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা সকলের জন্য অনুপ্রেরণা।
ভবিষ্যতের প্রতি প্রত্যাশা : তাঁর ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব, নিষ্ঠা ও দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে—দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, যদি আমরা একটি দেশপ্রেমিক, জনকল্যাণকামী এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠন করতে পারি। বাংলাদেশ ও প্রবাসী সমাজ আশা করে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চ্যালেঞ্জের সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ: বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কঠিন ও সংবেদনশীল সময়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাতীয় রূপান্তরের এই সন্ধিক্ষণে তাঁর দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে দেশের মানুষ নতুন আশার আলো দেখতে শুরু করে। তাঁর সাহসী পদক্ষেপ ও স্বচ্ছ নীতিমালার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন—যদি সঠিক নেতৃত্ব থাকে, তবে বাংলাদেশ বারবার শক্তির উৎসে পরিণত হতে পারে।
যোগ্য মন্ত্রিসভা না থাকায় সম্ভাবনার অপচয় :তবে বিশ্লেষকদের মতে, যদি তাঁর অধীনে একটি দক্ষ ও অভিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ থাকত, তাহলে এই রূপান্তরের গতি আরও ত্বরান্বিত হতো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়—বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়—যথাযথভাবে পরিচালিত হয়নি বলেই মনে করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আজও এমন বহু রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক রয়েছেন, যারা পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারা দলীয় স্লোগানধারী হিসেবে কাজ করেছেন এবং এখনো দায়িত্বে রয়েছেন, যদিও তারা দেশের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের স্বার্থে কার্যকরভাবে কাজ করছেন না। মন্ত্রণালয়টির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংস্কার জরুরি হলেও, এখনো তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
জনপ্রশাসনে ব্যর্থতা ও জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। প্রশাসনের শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত দলীয় আনুগত্যে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু এখনো তেমন কোনো তদন্ত বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রশ্ন, যে কারণে এই খাতগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
পুলিশের ভূমিকা ও অন্যান্য দপ্তরের সংস্কার :
এছাড়াও পুলিশ প্রশাসন সহ দেশের সব বড় মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে জরুরি ভিত্তিতে কাঠামোগত ও মানবসম্পদ ভিত্তিক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল। পরিবর্তন না আনলে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হতেই থাকবে।
জাতীয় স্বার্থে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত প্রয়োজন : ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক অরাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা জাতিকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তবে তাঁর এই প্রয়াসকে সফল করতে হলে উপযুক্ত প্রশাসন ও দক্ষ সহযোদ্ধা দরকার—তা না হলে তাঁর প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাবে না।
ড. ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর, কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও নির্বাচন পরিচালনায় প্রস্তাবিত করণী
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক যুক্তরাজ্য সফর কূটনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যেহেতু তিনি এই সরকারের প্রধান এবং একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, তাঁর এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং কৌশলগত গুরুত্বও বহন করত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশ হাই কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুর্বল প্রস্তুতি ও ব্যর্থ কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এই সফরের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়া ও কূটনৈতিক বিভ্রাট : ড. ইউনূসের সফরের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রিষি সুনাকের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক নিশ্চিত করতে না পারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাই কমিশনের জন্য একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতের জন্য আগেভাগেই যোগাযোগ ও চূড়ান্তকরণ করা হয়ে থাকে। সফরের সময় হঠাৎ করে সাক্ষাতের চেষ্টা করা অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক।
এছাড়াও, যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল ও সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগও গ্রহণ করা যেত, যা ব্রিটিশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারত এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে পারত।
প্রেস সচিবের বক্তব্য ও সমালোচনার ঝড় : এই সফর ঘিরে প্রেস সচিবের ভূমিকা ও বিবৃতি নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। দায়িত্বশীল আচরণ ও কৌশলগত বিবেচনার ঘাটতি এখানে স্পষ্ট।
জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন : “দেরিতে হলেও ভালো”—এই নীতিতে এখনো সময় আছে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার। বিশেষ করে বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও হাই কমিশনে জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন আনা উচিত। যোগ্য, নিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের মাধ্যমে কূটনীতিতে গতি ও স্বচ্ছতা ফেরানো সম্ভব।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় করণীয় সুপারিশ :
একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:
১. জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই নিশ্চিত করতে হবে।
২. ইউএনও ও এসি (ল্যান্ড) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত ও পেশাগত অতীত পর্যালোচনা করতে হবে।
৩. পুলিশ সুপার, অফিসার ইন চার্জ (ওসি) এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পেশাগত নিরপেক্ষতা যাচাই অপরিহার্য।
৪. বিভাগীয় কমিশনারদের নিয়োগে ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৫. গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা সব সচিবদের নিয়োগেও এই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।
৬. অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরেও এই প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার আনতে হবে।
একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার : অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকারের একটি দৃষ্টান্তমূলক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি হবে একটি দুর্নীতিমুক্ত, যোগ্যতাভিত্তিক ও স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থার সূচনা, যা আগামী দিনের গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করবে।
অ্যাডভোকেট শফিকুল হক
সাবেক সলিসিটর, সাবেক মেয়র
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল, লন্ডন