অভিবসান ডেস্ক :: সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসা শুরু হয়েছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ‘দ্য ক্লিনিক’ নামের একটি বিশেষায়িত বেসরকারি হাসপাতালের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্যাট্রিক কেনেডির তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে দ্য ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। তার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এখন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
এর আগে বেগম জিয়াকে বহনকারী কাতারের রাজপরিবারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টা ১৫ মিনিট) হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছায়।
উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা ছাড়েন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
হিথরো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও পুত্রবধূ জুবাইদা রহমান। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হজরত আলী খান বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। যুক্তরাজ্য বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারাও বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান। বিএনপির চেয়ারপারসনের আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দরের বাইরে সমবেত হন দলের কয়েক’শ নেতাকর্মী। সেখানে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষে হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা করেন বিএনপির নেত্রী।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য গতকাল মঙ্গলবার রাতে কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি।
চিকিৎসকসহ ১৫ জন খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী। তাদের মধ্যে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সিঁথি রহমানও আছেন। তবে তিনি কবে দেশে ফিরবেন, তা নিশ্চিত নয়।
এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক আল মামুন সমকালকে জানান, উন্নত চিকিৎসায় খালেদা জিয়া কত দিন বিদেশে থাকবেন, তা দেশি-বিদেশি চিকিৎসকের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড বলতে পারবে। বোর্ড যেভাবে পরামর্শ দেবে, সেভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চলবে। তিনি লিভারসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত। লম্বা চিকিৎসা নিতে দেড়-দুই মাস লাগতে পারে। তবে এর আগে সুস্থ হয়ে গেলে দেশে চলে আসবেন। বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান।
২০০৭ সালে কারাবন্দি দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল তৎকালীন সেনা-সমর্থিত সরকার, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নামে পরিচিত। সে সময় শেখ হাসিনা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ গেলেও, দেশে থাকার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন খালেদা জিয়া।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালান। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা, গুম, খুনের মামলা চলছে। তাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার মাধ্যমে গত সাড়ে চার দশকে এই প্রথম দুই নেত্রী বিদেশে। দুই রাজনৈতিক পরিবারেরও কেউ নেই দেশে।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রায় সরকারি বাধা না থাকলেও তিনি পাঁচ মাস সময় নিয়েছেন। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, তারেক রহমান দেশে না থাকায় বিদেশে যাননি খালেদা জিয়া। একসঙ্গে দু’জনের অনুপস্থিতি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল। যদিও সরকারের দিক থেকে আশ্বস্ত করা হয়, কাউকে মাইনাস করার ইচ্ছা নেই। গত ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, তখনই স্পষ্ট হয়– বিএনপি নেত্রীর বিদেশযাত্রায় ঝুঁকি নেই।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরের দুই বছর খালেদা জিয়া পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে একাকী কাটান দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে। বাসায় থাকা, রাজনীতি না করাসহ নানা শর্তে নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের মার্চে সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেওয়া হয়। পরের চার বছরের অধিকাংশ সময় হাসপাতালে কাটে নানা রোগের জটিলতায়। লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, করোনাসহ নানা রোগে তাঁকে একাধিকবার আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বারবার আবেদনেও আওয়ামী লীগ সরকার চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেয়নি।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিনই খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি। তবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করা খালেদা জিয়া আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার সাজা থেকে খালাস পেয়েছেন। অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সাজা স্থগিত হয়েছে আপিল বিভাগে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয় ১/১১ সেনা-সমর্থিত ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। এর পাঁচটি ছিল দুর্নীতির। নাইকো মামলা বিচারাধীন। গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা থেকে সম্প্রতি অব্যাহতি পেয়েছেন। নাশকতা ও মানহানির ৩২ মামলা থেকেও মুক্তি পেয়েছেন খালাস, খারিজ ও অব্যাহতির মাধ্যমে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং নাইকো মামলা চলমান থাকলেও সাজামুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হয়েছেন।
খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা উপলক্ষে গতকাল বিকেল থেকে গুলশান ঘিরে ছিল বিএনপি নেতাকর্মীর ঢল। সন্ধ্যা ৬টার দিকে একটি গাড়িতে তাঁর লাগেজ বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। রাত সোয়া ৮টার দিকে ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-২৬১২ নম্বরের গাড়িতে খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে রওনা দেন। এত দিন হুইলচেয়ার লাগলেও গতকাল বাসা থেকে তিনি হেঁটে এসে গাড়িতে ওঠেন। এর আগে তার সঙ্গে মির্জা ফখরুলসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা দেখা করেন।
খালেদা জিয়াকে গাড়িতে তোলার সময় নেতাকর্মীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। নেতাকর্মীর ভিড়ের কারণে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়ি রাজনৈতিক শোভাযাত্রার মতো ধীরগতিতে বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যায়। শুধু ঢাকা নয়; গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের জেলা থেকেও নেতাকর্মী আসেন। তারা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সড়কের দুই পাশে দাঁড়ান। খালেদা জিয়ার নামে নানা স্লোগান দেন।
নেতাকর্মীর কারণে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ রুটে সাধারণ যাত্রীদের চলাচলের জন্য বেশ কিছু জায়গায় বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে বলা হয়। নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয় গুলশান থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথজুড়ে। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, র্যাব, এপিবিএন, আনসার বাহিনীসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরাও অবস্থান নেন। ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া।
২০১৭ সালের ১৬ জুলাই সর্বশেষ যুক্তরাজ্যে যান খালেদা জিয়া। ওই বছরের ১৮ অক্টোবর দেশে ফেরেন তিনি। সেই সময় খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্যের ডা. হ্যাডলি ব্যারির অধীনে চিকিৎসা নেন।
বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ সমকালকে বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে জিয়া অরফানেজ ও জজ আদালতে নাইকো দুর্নীতির মামলা চলছে। নাইকো মামলায় ৬৮ সাক্ষীর ৩২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণ ১৪ জানুয়ারি। এসব মামলায় খালেদা জিয়া জামিনে আছেন। ফলে এখন উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ যেতে আইনি বাধা নেই তার।