ঢাকা ০২:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিল্পনীতিতে পর্যটনের খাত উপ-খাত ভ্রান্তি

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০২:১৪:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ মে ২০২৫
  • ০ বার পড়া হয়েছে

জামিউল আহমেদ :: কথা হচ্ছিল ঘোড়া আর গাধার মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে। প্রথম ব্যক্তি দাবী করলো সে তার জীবনে অনেকবার গরুর রচনা লিখেছে। সেই সূত্রে না দেখলেও ঘোড়া আর গাধার পার্থক্য বোঝা তার জন্য তেমন কিছু নয়। কেন না গাধা আর ঘোড়া গরুর মতই চতুষ্পদ প্রাণী। এই বলে সে গাধার বর্ণনা দিতে গিয়ে বললো, গাধার খাড়া দুটি শিং রয়েছে। এমন বয়ান শুনামাত্রই দ্বিতীয় ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বুঝেছি তুমি ঘোড়াও চিনোনা এবং গাধাও চিনোনা।

সেই দশা হয়েছে জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটনের শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে। যেখানে পণ্যকে শিল্প, খাতকে উপখাত এবং উপখাতকে শিল্পের নামে অশিল্প দিয়ে ভরাট করা হয়েছে দেদারছে। এতেকরে শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাতকে জগাখিচুড়ি করে নিরেট তালগোল পাকানো হয়েছে। যা থেকে প্রতীয়মান হয় ঐ ঘোড়া আর গাধার বর্ণনার মত পর্যটনের শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত কোনটা সম্পর্কেই নির্ণায়কদের ন্যুনতম কোন ধারণা নেই। আর এই নিয়েই চলছে আমাদের তিপান্ন বছরের পর্যটন। ফলশ্রুতিতে সম্ভাবনাময় পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের কোন লক্ষনই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছেনা।

কেন না পর্যটন এখন শুধু একটি শিল্পই নয় একক সর্ববৃহৎ শিল্প। যার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই এর মধ্যেকার শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত নির্ণয় বা চিহ্নিত করা যেমনি অতি প্রয়োজনীয় তেমনি সাবধানী হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। তা নাহলে এবং কোন ভুল ভ্রান্তি থাকলে শুধু পর্যটন কর্মকাণ্ডই নয় সার্বিক উন্নয়ন কর্মই তালেগোলে হয়ে যাবে। কেন না এই শিল্পটির উন্নয়নের জন্য শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। আর তা মূলত সঠিক শিল্পনীতির মাধ্যমেই করা সম্ভব। কিন্তু সেই শিল্পনীতিতেই যদি এমন গলদ থাকে তাহলে সব উদ্যোগই বৃথা যাবে।

তাহলে দেখা যাক শিল্পনীতিতে কি থাকার কথা এবং কি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই শিল্পনীতিতে পর্যটনকে স্থান দেয়া এবং এটি কোন পর্যায়ের শিল্প তা নির্ণয়ের কাজটি করতে হয়। তারপর আসে কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কিভাবে সহায়তা দেয়া হবে এবং বিশেষ করে অগ্রাধিকার দেয়া হবে কি না তা নিশ্চিত করা। শেষতক আসে সবচেয়ে জরুরী যে কাজটি অর্থাৎ এই শিল্পের যে খাতগুলো রয়েছে তা অনুসরণ করে প্রতিটি খাতের উপখাতগুলোকে যতোটা সম্ভব সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। তা নাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে শিল্প সহায়ক সুবিধা দেয়া হবে কিংবা কোথায় কতটুকু বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে তা একেবারেই অস্পষ্ট থেকে যায়।

তাহলে প্রথমেই দেখা যাক আমাদের শিল্পনীতিতে শিল্প এবং পর্যটন শিল্প বলতে কি বুঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় সর্বশেষ শিল্পনীতি ২০২২ এর ৩য় অধ্যায়ে শিল্প বলতে উৎপাদন এবং সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে বুঝানো হয়েছে। যেজন্য বলা হয়েছে পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকণ ও সংযোজনের সাথে সম্পৃক্ত। সেবা নির্ভর শিল্প হিসেবে পর্যটনের জন্য তা মোটামুটি ঠিক আছে। তবে, দেখার বিষয় হলো এটি অনুসরণ করে জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটন শিল্পের জন্য বাকী কাজগুলো কি সঠিকভাবে করা হয়েছে।

এজন্য শিল্পনীতিতে পর্যটন বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা খতিয়ে দেখা যাক। এখানেও অর্থাৎ ২০২২ সালের শিল্পনীতির অধ্যায় ৩ এর ৩.২৬ অনুচ্ছেদে পর্যটনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশ্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ইউ এন ডাবলু টি ও এর সংজ্ঞাটি ব্যবহার না করে নিজেদের মত করে একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। যা মোটেই ঠিক নয় এবং বিভ্রান্তিকর। যেমন বলা হয়েছে “পর্যটন হলো এক ধরণের বিনোদন, অবসর সময়ে অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ”।

তার সাথে যোগ করা হয়েছে, “সামগ্রিকভাবে পর্যটন শিল্প বলতে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক স্থানে ভ্রমণ, চারু ও কারু শিল্পের ঐতিহ্য ও স্থাপনা দর্শন, বনাঞ্চল ও জীব-বৈচিত্রের দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ, বিভিন্ন প্রকার আবাসন এবং চিত্তবিনোদনমুলক কর্মকাণ্ডকে বুঝাবে”। এর দ্বারা অন্যরা দূরে থাক কর্তা ব্যক্তিরা নিজেরাইবা কি বুঝেছেন তা নিয়ে সন্দেহ হয়। কেন না এই সংজ্ঞা পর্যটনের কোন সংজ্ঞাতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পকে অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তির জালে জড়ানো হয়েছে বৈ আর কিছু নয়।

এবার আসা যাক পর্যটনের খাত-উপখাত প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে প্রথমেই পর্যটনের প্রকৃত খাত এবং উপখাতগুলো কি কি তা জেনে নেয়া যাক। শতভাগ সেবা নির্ভর শিল্প হিসেবে বিশ্বজনীনভাবে পর্যটনের প্রতিষ্ঠিত খাতগুলো হচ্ছে, একঃ যানবাহন বা পর্যটন যান, দুইঃ আবাসন, তিনঃ খাবার ও পানীয়, চারঃ বিনোদন (এগুলো প্রত্যেকটিই মুল সেবা সরবরাহকারী) এবং পাঁচঃ ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস (যারা মূল সেবা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সেবা এনে পর্যটকদের সরবরাহ করে থাকে। এজন্য এদেরকে বলা হয় মধ্যমা)। তারপর আসে প্রতিটি খাতের উপখাতগুলো যেখানে দেশভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে পর্যটনের খাতওয়ারী উপখাতগুলো কি কি হতে পারে সে সম্পর্কে একটি ধারণা নেয়া যাক।

(১) যানবাহন বা পর্যটন যানঃ এখানে আবার কয়েকটি ভাগ রয়েছে যেমন আকাশ, স্থল এবং জলযান। আকাশ যানের মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী বিমান, হেলিকপ্টার, স্কাইডাইভার, প্যারাগ্লাইডার, প্যারামোটর, ক্যাবল কার, হট এয়ার বেলুন ইত্যাদি; স্থলযানের মধ্যে রয়েছে রাস্তায় চালিত পর্যটন বাস, মিনি বাস, কোষ্টার, লিমোজিন, ট্যাক্সি এবং রেলগাড়ি ইত্যাদি; জলযানের মধ্যে রয়েছে রিভার ক্রুজার, সী ক্রুজার, ষ্টিমার, ওয়াটার বাস, ক্যাটামেরান, মোটরবোট, স্পিড বোট, কান্ট্রি বোট ইত্যাদি যেগুলো পর্যটক বহনকারী যান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

(২) আবাসনঃ এর মধ্যে রয়েছে হোটেল, মোটেল, বোটেল, রিসোর্ট, গেষ্ট হাউজ, এপার্টমেন্ট, ডরমিটরি, পেন্ডোমনিয়াম, ট্যুরিস্ট হোম, কটেজ, লজ, ভিলা, ইয়থ হোষ্টেল ইত্যাদি আবাসন সুবিধা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান যেগুলো হোটেল আইনের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে।

(৩) খাবার ও পানীয়ঃ এর মধ্যে রয়েছে রেষ্টুরেন্ট, আইটেম রেষ্টুরেন্ট, ক্যাজুয়াল ডাইনিং, ক্যাফেটেরিয়া, ফুডকোর্ট, টেক ওয়ে, ফাষ্টফুড সপ, স্যান্ডউইস বার, কফি হাউস, ড্রিংকস হাউস, বার, পাব ইত্যাদি যেগুলো রেস্তোরাঁ আইনের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে।

(৪) বিনোদনঃ বিনোদনের আবার দুটি ভাগ রয়েছে। যেমন ইনডোর এন্টারটেইনমেন্ট বা গৃহ-অভ্যন্তর বিনোদন এবং আউটডোর এন্টারটেইনমেন্ট বা বহিরাংগন বিনোদন। বহিরাংগন বিনোদনের মধ্যে রয়েছে পার্ক, থিম পার্ক, চিলড্রেন পার্ক, এমিউজমেন্ট পার্ক, সাফারি পার্ক, ওয়াটার পার্ক, সী সাইড একুইরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার স্যাঞ্চুয়ারী, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঞ্চুয়ারী, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, গলফ কোর্স, ওপেন কনসার্ট ইত্যাদি। গৃহ-অভ্যন্তর বিনোদনের মধ্যে রয়েছে থিয়েটার, ডিনার থিয়েটার, নাট্য মঞ্চ, যাত্রানুষ্ঠান, সার্কাস, হেলথ ক্লাব, ফুড ক্লাব, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো, গেম্বলিং হাউস, ডিসকো, ফ্যাশন শো, লাইভ শো ইত্যাদি।

(৫) ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরসঃ এই মধ্যমাদের মধ্যে রয়েছে ট্র্যাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর, গ্রাউন্ড অপারেটর, ট্যুর অরগানাইজার, ট্যুর ব্রোকার ইত্যাদি।

এই যখন বিশ্বজনিনভাবে পর্যটনের খাত-উপখাতের একটি প্রচ্ছন্ন চিত্র তখন আমাদের জাতীয় শিল্পনীতিতে এগুলোকে এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা না গেলে শিল্প সহায়ক সুবিধা এবং অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধা প্রাপ্তি যে মাঠে মারা যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে দেখা যাক সর্বশেষ জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২সহ পূর্ববর্তী কয়েকটি শিল্পনীতিতে পর্যটনকে তার খাত-উপখাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কিভাবে স্থান দেয়া হয়েছে বা উল্লেখ করা আছে। যা অতীত থেকে শুরু করে আজ অবধি জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটনের উপস্থিতিকে সার্বিক ও ধারাবাহিকভাবে জানতে সাহায্য করবে।

এক্ষেত্রে আমরা যদি ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ২০১০, ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের শিল্পনীতিগুলোর দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পাবো ২০০৫ সালের শিল্পনীতিতে পরিশিষ্টে (এনেক্সার) উল্লেখিত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৩৩ টি শিল্পের মধ্যে পর্যটনকে ২১তম ক্রমিকে রাখা হয়েছে। তবে তাতে খাত-উপখাতের কোনই উল্লেখ নেই। তারপর ২০১০ সালের শিল্পনীতিতে পর্যটনকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় ৫ম ক্রমিকে স্থান দেয়া হয়েছে। তবে, এই প্রথম পর্যটনের “খাত-উপখাত” নয় “বেসরকারি খাতভুক্ত প্রোডাক্টসমুহ” শীরোনামে একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে।

এতে প্রোডাক্ট বা পণ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে ১. বেসরকারি পর্যটন কেন্দ্র ২. হোটেল/মোটেল/কটেজ/হানটিং লজ/হলিডে হোম ইত্যাদি ৩. সকল প্রকার রাইডস ৪. থীম পার্ক ৫. ট্যুরিষ্ট রিসোর্ট ৬. এ্যামিউজমেন্ট পার্ক ৭. ফ্যামিলি ফান এন্ড গেইমস ৮. পিকনিক স্পট ৯. স্যূটিং স্পট ১০. হেলথ ক্লাব ১১. চিলড্রেন পার্ক ১২. দেশীয় সংস্কৃতি ভিত্তিক নৃত্য ও অন্যান্য প্রদর্শনীর জন্য স্থায়ী মঞ্চ ১৩. বার্ডস/বাটার ফ্লাই পার্ক ১৪. সাফারী পার্ক/চিড়িয়াখানা ১৫. নৌ ও সমূদ্র কুজিন ১৬. সী-সাইড এক্যুরিয়াম ১৭. সাইট সিয়িং ট্যুর। অথচ এই সবগুলো হওয়ার কথা প্রোডাক্ট বা পণ্য নয় ইন্ডাষ্ট্রি বা শিল্প খাত এবং উপখাত।

আবার ২০১৬ সালের শিল্পনীতিতে পর্যটনকে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতের ২৩ টির মধ্যে ৫ম স্থানে রাখা হয়েছে। একই সাথে “বেসরকারি খাতভুক্ত ট্যুরিজম শিল্প সমূহ” শীরোনামে যে তালিকা দেয়া হয়েছে তাতে কোন পরিবর্তন না করে ২০১০ সালের তালিকাটিকে হুবহু বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায় অগ্রাধিকার প্রাপ্তের তালিকায় পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে আসলেও এই শিল্পের খাত-উপখাতকে ২০১০ সালে “খাতভুক্ত প্রোডাক্ট” বলা হয়েছে। তাহলে বুঝা গেলো ইণ্ডাষ্ট্রি বা শিল্প এবং প্রোডাক্ট বা পণ্য কি এবং পার্থক্যটা কি এইটুকুও কর্তৃপক্ষের জানা ছিলোনা।

যেজন্য ২০১০ সালের একই তালিকাকে ২০১৬ সালে এসে প্রোডাক্ট বা পণ্যের স্থলে ইন্ড্রাষ্ট্রি বা শিল্প বলা হয়েছে। তার অর্থ দাঁড়ালো একই তালিকা একেকবার একেক পরিচয় দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত আইটেমগুলো পর্যটনের সত্যিকার খাত-উপখাতের মধ্যেতো পড়েইনি উপরন্তু অনেকগুলো বাদও পড়েছে। যেমন ক্রমিক ১, ২, ৫ আবাসন খাতের উপখাত এবং বাদবাকি সবগুলো বিনোদন খাতের উপখাতভুক্ত। এতে পর্যটনের মূল পাঁচটি খাতের মধ্যে আবাসন খাতের কয়েকটি এবং বিনোদন খাতের বেশ কয়েকটি উপখাত স্থান পেলেও পর্যটন শিল্পের মূল খাতগুলো অর্থাৎ যানবাহন বা পর্যটন যান, খাবার ও পানীয় এবং ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস খাতের কোন নাম গন্ধই নেই।

এবার আসা যাক সর্বশেষ ২০২২ সালের শিল্পনীতিতে। এখানেও পর্যটনকে এগিয়ে এনে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্পের তালিকার ১৩ ক্রমিকের মধ্যে ৩য় ক্রমিকে রাখা হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে মহাযজ্ঞ যা অনেকটা এলাহী কাণ্ডের মতই। কেন না বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে ধরা পড়ে শিল্পনীতিটির খাত-উপখাতের দিকে নজর দিলে। যেমন এটির পরিশিষ্ট ১০-এ বলা হয়েছে, “পর্যটন শিল্পের আওতাভুক্ত সম্ভাব্য শিল্পের তালিকা”। তাতে শীরোনাম রয়েছে, “পর্যটনের ১২ টি উপখাত নিম্নরূপ”। তাতে ক্রমিক ১, ২, ৩, ৪ ও ৬ এই পাঁচটিতে পর্যটনের মূল খাত যথাক্রমে যানবাহন, খাবার ও পানীয়, আবাসন, বিনোদন এবং ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস এর আওতাভুক্ত উপখাতগুলো শীরোনামে ভুল হলেও বলা যায় ভুল-শুদ্ধ মিলিয়ে মোটামোটি উল্লেখ করা হয়েছে।

কেননা এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু উপখাতকে কোন যুক্তি ছাড়া স্রেফ মনগড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন যানবাহনে পালকি, মহিষের গাড়ী; আবাসনে তাবু; বিনোদনে রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি। অথচ এসব খাতের অনেকগুলোর উপখাতে বহু উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেগুলো বাদ পড়েছে। তবুও মেনে নেয়া যায় এজন্য যে এসব ভুলত্রুটি সাপেক্ষে অন্তত কিছুটা হলেও পর্যটন শিল্পের প্রচলিত খাত-উপখাতগুলো স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাদবাকীগুলোর দিকে নজর দিলে তখনই আবার ঐ ঘোড়া আর গাধার কাহিনী মনে পড়ে যায়। কেন না এগুলোর কোনটিই পর্যটন শিল্পের খাত কিংবা উপখাতের বিষয় নয়; এমনকি কোন শিল্পের মধ্যেও পড়েনা। তাই এগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত একান্তই দরকার, নাহয় বিভ্রান্তি দূর হবেনা।

যেমনটি ক্রমিক ৫-এ রয়েছে “পর্যটন কার্যক্রম” খাত। পর্যটন শিল্পে এই নামে কোন খাত নেই এবং এর উপখাতের তালিকায় স্থান পেয়েছে কৃষি পর্যটন, খাদ্য পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন, স্বাস্থ্যা পর্যটন, শিক্ষা পর্যটন ইত্যাদি। ঐগুলো কোন শিল্পতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পের প্রতিষ্ঠিত সব পণ্য। ক্রমিক ৭-এ রয়েছে “পর্যটন শিক্ষা” খাত যা পর্যটনের কোন খাতও নয় এবং শিল্পও নয়। তাই এর উপখাতে বর্ণীত বিষয়গুলো যেমন পর্যটন শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা ইত্যাদিও কোন শিল্প নয়। একইভাবে ক্রমিক ৮-এ রয়েছে “মিডিয়া ও প্রকাশনা” খাত। এটিও পর্যটন শিল্পের কোন খাত নয় এবং এর উপখাতে স্থান পাওয়া টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্টেড ও অনলাইন পত্রিকা ইত্যাদিও পর্যটন সম্পৃক্ত কোন শিল্প নয়।

একইভাবে ক্রমিক ৯-এ “প্রযুক্তি” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে ডিজিটাল, মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিকস প্রযুক্তি ইত্যাদি; ক্রমিক ১০-এ “ইভেন্ট” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে মাইস, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি; ক্রমিক ১১-তে “মার্কেটপ্লেস” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে সমবায় ভিত্তিক পর্যটন শপ ও মার্কেট, ডিজিটাল মার্কেট, ই-কমার্স ইত্যাদি; সর্বশেষ ক্রমিক ১২-তে “বিবিধ কর্মকান্ড” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে পর্যটন গ্রাম, পর্যটন নগরী, ইয়োগা সেন্টার, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার কোনটিই পর্যটনের মধ্যেকার কোন শিল্পতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পের কোন খাত বা উপখাতও নয়।

অতএব, প্রশ্ন হলো এত জগাখিছুড়ি তথা ভূল-ভ্রান্তির পর জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প হিসেবে রাখা এবং পর্যায়ক্রমে তালিকায় এগিয়ে নিয়ে আসার যৌক্তিকতা কিংবা কার্যকারিতা কি মূল্যহীন হয়ে পড়েনা? অবশ্যই পড়ে, যেহেতু এইবারই প্রথম নয় একেবারে শুরু থেকে আজ অবধি সব কয়টি শিল্পনীতিতেই পর্যটনকে এমন দশার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে এখন পর্যন্ত এসে ভুল-ভ্রান্তি মুক্ত হওয়াতো দূরে থাক উপরন্তু পর্যটন শিল্পটি আরো বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা, অকার্যকারিতা এমন কি অগ্রহণযোগ্যতার মধ্যে নিপতিত হলো বৈ আর কি। যার ফলশ্রুতিতে অবহেলিত পর্যটন শিল্পটি এই তিপান্ন বছরেও নিজের জন্য শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি।

এজন্য স্বাভাবিকভাবে আরো দু’টি প্রশ্ন সামনে আসে। তাহলো এসবের জন্য দায়ী কে বা কারা এবং সমাধানইবা কি? আমাদের জানামতে সর্বশেষ তথা ২০২২ সালের শিল্পনীতির জন্য পর্যটনের খাত-উপখাত বাছাই করে তালিকা তৈরীর দায়িত্ব পালন করে “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড”। তারা আবার পর্যটনের সব আলিশান নেতা ও বিশিষ্টজন এবং জ্ঞানী ও গুণীজন নিয়ে সভার পর সভা করে এমন কর্মটি করেছেন। তাই বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডসহ এদের সবাইকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। তবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও স্বল্পবিদ্যার লোকজনকে এমন অপকর্মের সার্বিক দায়িত্ব নিতে হবে।

অন্যদিকে সমাধানের বিষয়েও অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য এসব বিষয়ে সত্যিকার জ্ঞান রাখেন এমন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকজন খুঁজে বের করে তাদের সাহায্য নিয়ে এবং যথাযথ নিয়ম মেনে পর্যটনের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে খাত-উপখাত ইত্যাদি চিহ্নিত করে নতুন ও নির্ভুল তালিকা তৈরী করতে হবে। যাতে এধরনের মৌলিক এবং সার্বিক কোন ভুল-ভ্রান্তি আর না থাকে। তার সাথে অবশ্যই পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে ভাগ্য বিড়ম্বনায় থাকা এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি তার জন্য দেখভাল থেকে শুরু করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসব থেকে বরাবরের মত বঞ্চিত হয়ে থাকবে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)।

ট্যাগস :

শিল্পনীতিতে পর্যটনের খাত উপ-খাত ভ্রান্তি

শিল্পনীতিতে পর্যটনের খাত উপ-খাত ভ্রান্তি

আপডেট সময় ০২:১৪:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ মে ২০২৫

জামিউল আহমেদ :: কথা হচ্ছিল ঘোড়া আর গাধার মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে। প্রথম ব্যক্তি দাবী করলো সে তার জীবনে অনেকবার গরুর রচনা লিখেছে। সেই সূত্রে না দেখলেও ঘোড়া আর গাধার পার্থক্য বোঝা তার জন্য তেমন কিছু নয়। কেন না গাধা আর ঘোড়া গরুর মতই চতুষ্পদ প্রাণী। এই বলে সে গাধার বর্ণনা দিতে গিয়ে বললো, গাধার খাড়া দুটি শিং রয়েছে। এমন বয়ান শুনামাত্রই দ্বিতীয় ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, বুঝেছি তুমি ঘোড়াও চিনোনা এবং গাধাও চিনোনা।

সেই দশা হয়েছে জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটনের শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত নির্ণয়ের ক্ষেত্রে। যেখানে পণ্যকে শিল্প, খাতকে উপখাত এবং উপখাতকে শিল্পের নামে অশিল্প দিয়ে ভরাট করা হয়েছে দেদারছে। এতেকরে শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাতকে জগাখিচুড়ি করে নিরেট তালগোল পাকানো হয়েছে। যা থেকে প্রতীয়মান হয় ঐ ঘোড়া আর গাধার বর্ণনার মত পর্যটনের শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত কোনটা সম্পর্কেই নির্ণায়কদের ন্যুনতম কোন ধারণা নেই। আর এই নিয়েই চলছে আমাদের তিপান্ন বছরের পর্যটন। ফলশ্রুতিতে সম্ভাবনাময় পর্যটনের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের কোন লক্ষনই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছেনা।

কেন না পর্যটন এখন শুধু একটি শিল্পই নয় একক সর্ববৃহৎ শিল্প। যার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই এর মধ্যেকার শিল্প ও পণ্য এবং খাত ও উপখাত নির্ণয় বা চিহ্নিত করা যেমনি অতি প্রয়োজনীয় তেমনি সাবধানী হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। তা নাহলে এবং কোন ভুল ভ্রান্তি থাকলে শুধু পর্যটন কর্মকাণ্ডই নয় সার্বিক উন্নয়ন কর্মই তালেগোলে হয়ে যাবে। কেন না এই শিল্পটির উন্নয়নের জন্য শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। আর তা মূলত সঠিক শিল্পনীতির মাধ্যমেই করা সম্ভব। কিন্তু সেই শিল্পনীতিতেই যদি এমন গলদ থাকে তাহলে সব উদ্যোগই বৃথা যাবে।

তাহলে দেখা যাক শিল্পনীতিতে কি থাকার কথা এবং কি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই শিল্পনীতিতে পর্যটনকে স্থান দেয়া এবং এটি কোন পর্যায়ের শিল্প তা নির্ণয়ের কাজটি করতে হয়। তারপর আসে কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কিভাবে সহায়তা দেয়া হবে এবং বিশেষ করে অগ্রাধিকার দেয়া হবে কি না তা নিশ্চিত করা। শেষতক আসে সবচেয়ে জরুরী যে কাজটি অর্থাৎ এই শিল্পের যে খাতগুলো রয়েছে তা অনুসরণ করে প্রতিটি খাতের উপখাতগুলোকে যতোটা সম্ভব সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। তা নাহলে কোন কোন ক্ষেত্রে শিল্প সহায়ক সুবিধা দেয়া হবে কিংবা কোথায় কতটুকু বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে তা একেবারেই অস্পষ্ট থেকে যায়।

তাহলে প্রথমেই দেখা যাক আমাদের শিল্পনীতিতে শিল্প এবং পর্যটন শিল্প বলতে কি বুঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় সর্বশেষ শিল্পনীতি ২০২২ এর ৩য় অধ্যায়ে শিল্প বলতে উৎপাদন এবং সেবামূলক কর্মকাণ্ডকে বুঝানো হয়েছে। যেজন্য বলা হয়েছে পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকণ ও সংযোজনের সাথে সম্পৃক্ত। সেবা নির্ভর শিল্প হিসেবে পর্যটনের জন্য তা মোটামুটি ঠিক আছে। তবে, দেখার বিষয় হলো এটি অনুসরণ করে জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটন শিল্পের জন্য বাকী কাজগুলো কি সঠিকভাবে করা হয়েছে।

এজন্য শিল্পনীতিতে পর্যটন বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা খতিয়ে দেখা যাক। এখানেও অর্থাৎ ২০২২ সালের শিল্পনীতির অধ্যায় ৩ এর ৩.২৬ অনুচ্ছেদে পর্যটনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশ্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ইউ এন ডাবলু টি ও এর সংজ্ঞাটি ব্যবহার না করে নিজেদের মত করে একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। যা মোটেই ঠিক নয় এবং বিভ্রান্তিকর। যেমন বলা হয়েছে “পর্যটন হলো এক ধরণের বিনোদন, অবসর সময়ে অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ”।

তার সাথে যোগ করা হয়েছে, “সামগ্রিকভাবে পর্যটন শিল্প বলতে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক স্থানে ভ্রমণ, চারু ও কারু শিল্পের ঐতিহ্য ও স্থাপনা দর্শন, বনাঞ্চল ও জীব-বৈচিত্রের দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ, বিভিন্ন প্রকার আবাসন এবং চিত্তবিনোদনমুলক কর্মকাণ্ডকে বুঝাবে”। এর দ্বারা অন্যরা দূরে থাক কর্তা ব্যক্তিরা নিজেরাইবা কি বুঝেছেন তা নিয়ে সন্দেহ হয়। কেন না এই সংজ্ঞা পর্যটনের কোন সংজ্ঞাতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পকে অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তির জালে জড়ানো হয়েছে বৈ আর কিছু নয়।

এবার আসা যাক পর্যটনের খাত-উপখাত প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে প্রথমেই পর্যটনের প্রকৃত খাত এবং উপখাতগুলো কি কি তা জেনে নেয়া যাক। শতভাগ সেবা নির্ভর শিল্প হিসেবে বিশ্বজনীনভাবে পর্যটনের প্রতিষ্ঠিত খাতগুলো হচ্ছে, একঃ যানবাহন বা পর্যটন যান, দুইঃ আবাসন, তিনঃ খাবার ও পানীয়, চারঃ বিনোদন (এগুলো প্রত্যেকটিই মুল সেবা সরবরাহকারী) এবং পাঁচঃ ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস (যারা মূল সেবা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সেবা এনে পর্যটকদের সরবরাহ করে থাকে। এজন্য এদেরকে বলা হয় মধ্যমা)। তারপর আসে প্রতিটি খাতের উপখাতগুলো যেখানে দেশভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে পর্যটনের খাতওয়ারী উপখাতগুলো কি কি হতে পারে সে সম্পর্কে একটি ধারণা নেয়া যাক।

(১) যানবাহন বা পর্যটন যানঃ এখানে আবার কয়েকটি ভাগ রয়েছে যেমন আকাশ, স্থল এবং জলযান। আকাশ যানের মধ্যে রয়েছে যাত্রীবাহী বিমান, হেলিকপ্টার, স্কাইডাইভার, প্যারাগ্লাইডার, প্যারামোটর, ক্যাবল কার, হট এয়ার বেলুন ইত্যাদি; স্থলযানের মধ্যে রয়েছে রাস্তায় চালিত পর্যটন বাস, মিনি বাস, কোষ্টার, লিমোজিন, ট্যাক্সি এবং রেলগাড়ি ইত্যাদি; জলযানের মধ্যে রয়েছে রিভার ক্রুজার, সী ক্রুজার, ষ্টিমার, ওয়াটার বাস, ক্যাটামেরান, মোটরবোট, স্পিড বোট, কান্ট্রি বোট ইত্যাদি যেগুলো পর্যটক বহনকারী যান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

(২) আবাসনঃ এর মধ্যে রয়েছে হোটেল, মোটেল, বোটেল, রিসোর্ট, গেষ্ট হাউজ, এপার্টমেন্ট, ডরমিটরি, পেন্ডোমনিয়াম, ট্যুরিস্ট হোম, কটেজ, লজ, ভিলা, ইয়থ হোষ্টেল ইত্যাদি আবাসন সুবিধা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠান যেগুলো হোটেল আইনের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে।

(৩) খাবার ও পানীয়ঃ এর মধ্যে রয়েছে রেষ্টুরেন্ট, আইটেম রেষ্টুরেন্ট, ক্যাজুয়াল ডাইনিং, ক্যাফেটেরিয়া, ফুডকোর্ট, টেক ওয়ে, ফাষ্টফুড সপ, স্যান্ডউইস বার, কফি হাউস, ড্রিংকস হাউস, বার, পাব ইত্যাদি যেগুলো রেস্তোরাঁ আইনের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে।

(৪) বিনোদনঃ বিনোদনের আবার দুটি ভাগ রয়েছে। যেমন ইনডোর এন্টারটেইনমেন্ট বা গৃহ-অভ্যন্তর বিনোদন এবং আউটডোর এন্টারটেইনমেন্ট বা বহিরাংগন বিনোদন। বহিরাংগন বিনোদনের মধ্যে রয়েছে পার্ক, থিম পার্ক, চিলড্রেন পার্ক, এমিউজমেন্ট পার্ক, সাফারি পার্ক, ওয়াটার পার্ক, সী সাইড একুইরিয়াম, আন্ডার ওয়াটার স্যাঞ্চুয়ারী, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঞ্চুয়ারী, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, গলফ কোর্স, ওপেন কনসার্ট ইত্যাদি। গৃহ-অভ্যন্তর বিনোদনের মধ্যে রয়েছে থিয়েটার, ডিনার থিয়েটার, নাট্য মঞ্চ, যাত্রানুষ্ঠান, সার্কাস, হেলথ ক্লাব, ফুড ক্লাব, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো, গেম্বলিং হাউস, ডিসকো, ফ্যাশন শো, লাইভ শো ইত্যাদি।

(৫) ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরসঃ এই মধ্যমাদের মধ্যে রয়েছে ট্র্যাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর, গ্রাউন্ড অপারেটর, ট্যুর অরগানাইজার, ট্যুর ব্রোকার ইত্যাদি।

এই যখন বিশ্বজনিনভাবে পর্যটনের খাত-উপখাতের একটি প্রচ্ছন্ন চিত্র তখন আমাদের জাতীয় শিল্পনীতিতে এগুলোকে এভাবে অন্তর্ভুক্ত করা না গেলে শিল্প সহায়ক সুবিধা এবং অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধা প্রাপ্তি যে মাঠে মারা যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে দেখা যাক সর্বশেষ জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২সহ পূর্ববর্তী কয়েকটি শিল্পনীতিতে পর্যটনকে তার খাত-উপখাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কিভাবে স্থান দেয়া হয়েছে বা উল্লেখ করা আছে। যা অতীত থেকে শুরু করে আজ অবধি জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটনের উপস্থিতিকে সার্বিক ও ধারাবাহিকভাবে জানতে সাহায্য করবে।

এক্ষেত্রে আমরা যদি ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে ২০১০, ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০২২ সালের শিল্পনীতিগুলোর দিকে নজর দেই তাহলে দেখতে পাবো ২০০৫ সালের শিল্পনীতিতে পরিশিষ্টে (এনেক্সার) উল্লেখিত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৩৩ টি শিল্পের মধ্যে পর্যটনকে ২১তম ক্রমিকে রাখা হয়েছে। তবে তাতে খাত-উপখাতের কোনই উল্লেখ নেই। তারপর ২০১০ সালের শিল্পনীতিতে পর্যটনকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকায় ৫ম ক্রমিকে স্থান দেয়া হয়েছে। তবে, এই প্রথম পর্যটনের “খাত-উপখাত” নয় “বেসরকারি খাতভুক্ত প্রোডাক্টসমুহ” শীরোনামে একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে।

এতে প্রোডাক্ট বা পণ্য হিসেবে স্থান পেয়েছে ১. বেসরকারি পর্যটন কেন্দ্র ২. হোটেল/মোটেল/কটেজ/হানটিং লজ/হলিডে হোম ইত্যাদি ৩. সকল প্রকার রাইডস ৪. থীম পার্ক ৫. ট্যুরিষ্ট রিসোর্ট ৬. এ্যামিউজমেন্ট পার্ক ৭. ফ্যামিলি ফান এন্ড গেইমস ৮. পিকনিক স্পট ৯. স্যূটিং স্পট ১০. হেলথ ক্লাব ১১. চিলড্রেন পার্ক ১২. দেশীয় সংস্কৃতি ভিত্তিক নৃত্য ও অন্যান্য প্রদর্শনীর জন্য স্থায়ী মঞ্চ ১৩. বার্ডস/বাটার ফ্লাই পার্ক ১৪. সাফারী পার্ক/চিড়িয়াখানা ১৫. নৌ ও সমূদ্র কুজিন ১৬. সী-সাইড এক্যুরিয়াম ১৭. সাইট সিয়িং ট্যুর। অথচ এই সবগুলো হওয়ার কথা প্রোডাক্ট বা পণ্য নয় ইন্ডাষ্ট্রি বা শিল্প খাত এবং উপখাত।

আবার ২০১৬ সালের শিল্পনীতিতে পর্যটনকে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতের ২৩ টির মধ্যে ৫ম স্থানে রাখা হয়েছে। একই সাথে “বেসরকারি খাতভুক্ত ট্যুরিজম শিল্প সমূহ” শীরোনামে যে তালিকা দেয়া হয়েছে তাতে কোন পরিবর্তন না করে ২০১০ সালের তালিকাটিকে হুবহু বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায় অগ্রাধিকার প্রাপ্তের তালিকায় পর্যটনকে এগিয়ে নিয়ে আসলেও এই শিল্পের খাত-উপখাতকে ২০১০ সালে “খাতভুক্ত প্রোডাক্ট” বলা হয়েছে। তাহলে বুঝা গেলো ইণ্ডাষ্ট্রি বা শিল্প এবং প্রোডাক্ট বা পণ্য কি এবং পার্থক্যটা কি এইটুকুও কর্তৃপক্ষের জানা ছিলোনা।

যেজন্য ২০১০ সালের একই তালিকাকে ২০১৬ সালে এসে প্রোডাক্ট বা পণ্যের স্থলে ইন্ড্রাষ্ট্রি বা শিল্প বলা হয়েছে। তার অর্থ দাঁড়ালো একই তালিকা একেকবার একেক পরিচয় দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত আইটেমগুলো পর্যটনের সত্যিকার খাত-উপখাতের মধ্যেতো পড়েইনি উপরন্তু অনেকগুলো বাদও পড়েছে। যেমন ক্রমিক ১, ২, ৫ আবাসন খাতের উপখাত এবং বাদবাকি সবগুলো বিনোদন খাতের উপখাতভুক্ত। এতে পর্যটনের মূল পাঁচটি খাতের মধ্যে আবাসন খাতের কয়েকটি এবং বিনোদন খাতের বেশ কয়েকটি উপখাত স্থান পেলেও পর্যটন শিল্পের মূল খাতগুলো অর্থাৎ যানবাহন বা পর্যটন যান, খাবার ও পানীয় এবং ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস খাতের কোন নাম গন্ধই নেই।

এবার আসা যাক সর্বশেষ ২০২২ সালের শিল্পনীতিতে। এখানেও পর্যটনকে এগিয়ে এনে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্পের তালিকার ১৩ ক্রমিকের মধ্যে ৩য় ক্রমিকে রাখা হয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে মহাযজ্ঞ যা অনেকটা এলাহী কাণ্ডের মতই। কেন না বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে ধরা পড়ে শিল্পনীতিটির খাত-উপখাতের দিকে নজর দিলে। যেমন এটির পরিশিষ্ট ১০-এ বলা হয়েছে, “পর্যটন শিল্পের আওতাভুক্ত সম্ভাব্য শিল্পের তালিকা”। তাতে শীরোনাম রয়েছে, “পর্যটনের ১২ টি উপখাত নিম্নরূপ”। তাতে ক্রমিক ১, ২, ৩, ৪ ও ৬ এই পাঁচটিতে পর্যটনের মূল খাত যথাক্রমে যানবাহন, খাবার ও পানীয়, আবাসন, বিনোদন এবং ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুরস এর আওতাভুক্ত উপখাতগুলো শীরোনামে ভুল হলেও বলা যায় ভুল-শুদ্ধ মিলিয়ে মোটামোটি উল্লেখ করা হয়েছে।

কেননা এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু উপখাতকে কোন যুক্তি ছাড়া স্রেফ মনগড়া অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন যানবাহনে পালকি, মহিষের গাড়ী; আবাসনে তাবু; বিনোদনে রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি। অথচ এসব খাতের অনেকগুলোর উপখাতে বহু উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেগুলো বাদ পড়েছে। তবুও মেনে নেয়া যায় এজন্য যে এসব ভুলত্রুটি সাপেক্ষে অন্তত কিছুটা হলেও পর্যটন শিল্পের প্রচলিত খাত-উপখাতগুলো স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাদবাকীগুলোর দিকে নজর দিলে তখনই আবার ঐ ঘোড়া আর গাধার কাহিনী মনে পড়ে যায়। কেন না এগুলোর কোনটিই পর্যটন শিল্পের খাত কিংবা উপখাতের বিষয় নয়; এমনকি কোন শিল্পের মধ্যেও পড়েনা। তাই এগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত একান্তই দরকার, নাহয় বিভ্রান্তি দূর হবেনা।

যেমনটি ক্রমিক ৫-এ রয়েছে “পর্যটন কার্যক্রম” খাত। পর্যটন শিল্পে এই নামে কোন খাত নেই এবং এর উপখাতের তালিকায় স্থান পেয়েছে কৃষি পর্যটন, খাদ্য পর্যটন, সাংস্কৃতিক পর্যটন, স্বাস্থ্যা পর্যটন, শিক্ষা পর্যটন ইত্যাদি। ঐগুলো কোন শিল্পতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পের প্রতিষ্ঠিত সব পণ্য। ক্রমিক ৭-এ রয়েছে “পর্যটন শিক্ষা” খাত যা পর্যটনের কোন খাতও নয় এবং শিল্পও নয়। তাই এর উপখাতে বর্ণীত বিষয়গুলো যেমন পর্যটন শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা ইত্যাদিও কোন শিল্প নয়। একইভাবে ক্রমিক ৮-এ রয়েছে “মিডিয়া ও প্রকাশনা” খাত। এটিও পর্যটন শিল্পের কোন খাত নয় এবং এর উপখাতে স্থান পাওয়া টেলিভিশন, রেডিও, প্রিন্টেড ও অনলাইন পত্রিকা ইত্যাদিও পর্যটন সম্পৃক্ত কোন শিল্প নয়।

একইভাবে ক্রমিক ৯-এ “প্রযুক্তি” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে ডিজিটাল, মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিকস প্রযুক্তি ইত্যাদি; ক্রমিক ১০-এ “ইভেন্ট” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে মাইস, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি; ক্রমিক ১১-তে “মার্কেটপ্লেস” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে সমবায় ভিত্তিক পর্যটন শপ ও মার্কেট, ডিজিটাল মার্কেট, ই-কমার্স ইত্যাদি; সর্বশেষ ক্রমিক ১২-তে “বিবিধ কর্মকান্ড” খাত এবং এর উপখাত হিসেবে পর্যটন গ্রাম, পর্যটন নগরী, ইয়োগা সেন্টার, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার কোনটিই পর্যটনের মধ্যেকার কোন শিল্পতো নয়ই উপরন্তু পর্যটন শিল্পের কোন খাত বা উপখাতও নয়।

অতএব, প্রশ্ন হলো এত জগাখিছুড়ি তথা ভূল-ভ্রান্তির পর জাতীয় শিল্পনীতিতে পর্যটন শিল্পকে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প হিসেবে রাখা এবং পর্যায়ক্রমে তালিকায় এগিয়ে নিয়ে আসার যৌক্তিকতা কিংবা কার্যকারিতা কি মূল্যহীন হয়ে পড়েনা? অবশ্যই পড়ে, যেহেতু এইবারই প্রথম নয় একেবারে শুরু থেকে আজ অবধি সব কয়টি শিল্পনীতিতেই পর্যটনকে এমন দশার মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে এখন পর্যন্ত এসে ভুল-ভ্রান্তি মুক্ত হওয়াতো দূরে থাক উপরন্তু পর্যটন শিল্পটি আরো বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা, অকার্যকারিতা এমন কি অগ্রহণযোগ্যতার মধ্যে নিপতিত হলো বৈ আর কি। যার ফলশ্রুতিতে অবহেলিত পর্যটন শিল্পটি এই তিপান্ন বছরেও নিজের জন্য শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি।

এজন্য স্বাভাবিকভাবে আরো দু’টি প্রশ্ন সামনে আসে। তাহলো এসবের জন্য দায়ী কে বা কারা এবং সমাধানইবা কি? আমাদের জানামতে সর্বশেষ তথা ২০২২ সালের শিল্পনীতির জন্য পর্যটনের খাত-উপখাত বাছাই করে তালিকা তৈরীর দায়িত্ব পালন করে “বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড”। তারা আবার পর্যটনের সব আলিশান নেতা ও বিশিষ্টজন এবং জ্ঞানী ও গুণীজন নিয়ে সভার পর সভা করে এমন কর্মটি করেছেন। তাই বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডসহ এদের সবাইকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। তবে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন ও স্বল্পবিদ্যার লোকজনকে এমন অপকর্মের সার্বিক দায়িত্ব নিতে হবে।

অন্যদিকে সমাধানের বিষয়েও অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য এসব বিষয়ে সত্যিকার জ্ঞান রাখেন এমন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকজন খুঁজে বের করে তাদের সাহায্য নিয়ে এবং যথাযথ নিয়ম মেনে পর্যটনের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে খাত-উপখাত ইত্যাদি চিহ্নিত করে নতুন ও নির্ভুল তালিকা তৈরী করতে হবে। যাতে এধরনের মৌলিক এবং সার্বিক কোন ভুল-ভ্রান্তি আর না থাকে। তার সাথে অবশ্যই পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে ভাগ্য বিড়ম্বনায় থাকা এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি তার জন্য দেখভাল থেকে শুরু করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এসব থেকে বরাবরের মত বঞ্চিত হয়ে থাকবে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)।


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/obhibason/public_html/wp-includes/functions.php on line 5471