ঢাকা ১২:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
প্যারিসে জালালাবাদ এসোসিয়েশন ফ্রান্সের তৃতীয় সিলেট উৎসব সফলভাবে অনুষ্ঠিত নবীগঞ্জে ৫০ বছর পুর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী বাস্তবায়ন কমিটির  অভিষেক ও লোগো উন্মোচন সুনামগঞ্জ-৫ ছাতক-দোয়ারা বাজার আসনে গণফোরাম থেকে মনোনয়ম পেলেন টি এইচ এম জাহাঙ্গীর সিলেটের জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর দীপংকর দাস দ্বীপ আর নেই প্যারিসে কবিতা-সুর ও চিত্রে Festival Terres du Bengale সম্পন্ন লন্ডনে বড়লেখা ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশন ইউকে’র আয়োজনে জমজমাট ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত অনশন ভাঙিয়ে আমজনতার তারেককে হাসপাতালে পাঠালেন সালাহউদ্দিন সরকারের আশ্বাসে প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি সোমবার স্থগিত নাট্যসংঘ কানাডার চতুর্থ নাট্যোৎসব ৮-৯ নভেম্বর পর্তুগালের ছুরিকাঘাতে বাংলাদেশি খুন

প্রকৃতির পাঠশালায় শিশুরা: ফ্রান্সের এক অনন্য উদ্যোগ

শাহাবুদ্দিন শুভ :: জীবনে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এমন অনেক দৃশ্য বা বাস্তবতা আমাদের সামনে আসে, যা পূর্বে কল্পনাও করিনি। তখন মনে হয় —জীবন কত বৈচিত্র্যময়, আর শিক্ষা কত গভীর ও বিস্তৃত হতে পারে। তেমনি একটি অনন্য অভিজ্ঞতা আমি ফ্রান্সে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছে।

আমি বর্তমানে ফ্রান্সের এক ছোট শহর Le Creusot-এ বসবাস করছি। এখানে একটি ব্যাপার আমার মন ছুঁয়ে গেছে—সাপ্তাহিক হাতে-কলমে শিক্ষা কার্যক্রম, যেখানে শিশুদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে শেখানো হয় বাস্তব জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো। বছরে ৩/৪ দিন, এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একটি বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে এসে প্রকৃতিকে বোঝে, বাগান এবং খামারের কাজ শেখে এবং নিজের হাতে তা করে দেখে।

সাম্প্রতিক এক শুক্রবার আমি নিজে আমন্ত্রিত ছিলাম সেই বাগান পরিদর্শনের জন্য। এই প্রকল্পটি পরিচালনা করছে OPAC Saône-et-Loire নামক একটি সংগঠন, যেখানে নিয়মিত কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের নাম—Rénia, François, Seidath, Boubakar, Nadine, Abdou এবং Chantal । আমাকে এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছেন Justine Bénit ম্যাডাম, যিনি অত্যন্ত আন্তরিক ও শিক্ষানুরাগী একজন মানুষ। ওইদিন Le Creusot শহরের École Rosa Parks বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ জন ছাত্রছাত্রী, যাদের বয়স ৬ থেকে ৭ বছরের মধ্যে (শ্রেণি: CP এবং CE1), বাগানে এসেছিল। তারা বছরের বিভিন্ন ঋতুতে ৩/৪ বার বাগানে আসে, যেন প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করতে পারে এবং প্রকৃতির রূপান্তর ও বৈচিত্র্য জানতে পারে।

আমি যখন তাদের বাগানে প্রবেশ করতে দেখলাম, তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠল আনন্দের ঝিলিক, ছিল একরাশ কৌতূহল। ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গাছপালার পরিচর্যা শেখে। কীভাবে গাছের গোড়ায় নিড়ানি দিতে হয়, কীভাবে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, কীভাবে গাছের যত্ন নিতে হয়—সেগুলো তাদের হাতে-কলমে শেখানো হয়। শিশুরা অকপটে ও আনন্দের সঙ্গে সেই কাজগুলো করে, কোন হেজিটেশন বা দ্বিধা ছিল না তাদের মধ্যে। এমনকি তারা নিজেদের হাতে মাটি খুঁড়ছে, গাছের পাতা তুলে নিচ্ছে, আবার কাউকে কাউকে গাছের গোড়ায় পানি দিতেও দেখা গেছে।

সবচেয়ে চমৎকার অংশটি ছিল বাগানের পাশে থাকা একটি ছোট খামার। সেখানে কিছু মোরগ এবং অন্যান্য পাখি রাখা হয়েছে। শিশুদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তারা নিজের হাতে মোরগ ধরছে, খাবার দিচ্ছে, এবং খামারের পরিবেশ সম্পর্কে জানছে। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিশুদের মধ্যে একধরনের অনুভূতি ও ভালোবাসা তৈরি করে, যা কেবল বই পড়ে বা ছবিতে দেখে সম্ভব নয়।

আমার নিজের শৈশবও হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় বাড়ির পাশে টমেটো, বেগুন, সিম, ধনেপাতা গাছের বাগান ছিল। আমরা নিজেরা সেগুলোর পরিচর্যা করতাম, মাটি দিতাম, আগাছা তুলতাম। সেই স্মৃতিগুলো যেন হঠাৎ করে ফিরে এল, কিন্তু এবার অন্য এক ভূখণ্ডে, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে একদিকে যেমন আবেগতাড়িত করেছে, অন্যদিকে একটি প্রশ্নও জাগিয়েছে—আমরা কেন আমাদের দেশের শিশুদের জন্য এমন কিছু করতে পারি না? কেন আমাদের বিদ্যালয়গুলো এ ধরনের হাতে-কলমে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝে না? বাংলাদেশে থাকাকালে আমি চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে কৃষিকাজ দেখাতে, কিন্তু তা কখনো এই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শুধুমাত্র দেখে বোঝার চেয়ে, নিজ হাতে কাজ করার মধ্যে যে আনন্দ ও শিক্ষা লুকিয়ে আছে, তা অনন্য।

এমন শিক্ষা পদ্ধতি শুধু শিশুদের জ্ঞান বাড়ায় না, বরং তাদের চরিত্র গঠনের পথ প্রশস্ত করে। তারা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, পরিশ্রমের মর্যাদা শিখে, এবং কৃষিজীবীদের প্রতি সম্মান দেখাতে শেখে। যারা একসময় কেবল শহরবাসী হয়ে বেড়ে উঠতো, তাদের মধ্যেও এই অভিজ্ঞতা একটি নতুন জানালা খুলে দেয়। ভবিষ্যতে হয়তো তাদের মধ্য থেকেই কেউ কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে—ভালো লাগা আর দায়িত্ববোধ থেকে।

সবচেয়ে বড় কথা, এটি জাতি গঠনের ভিত্তি গড়তে সাহায্য করে। কারণ একটি জাতিকে সঠিকভাবে গড়তে চাইলে, শিক্ষাকে শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না—বাস্তব জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে তোলা আবশ্যক।

এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শুধু অনুপ্রাণিতই হইনি, বরং এটাও উপলব্ধি করেছি—ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এমন কার্যক্রম চালু করা কতটা প্রয়োজন। শিশুদের প্রকৃতিকে জানার সুযোগ দেওয়া মানেই তাদের জীবনের ভিত্তি আরও মজবুত করা। যদি আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতো, তবে কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন বাড়তো, তেমনি আমাদের সমাজে কৃষক শ্রেণির প্রতি সম্মানও বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।

 

লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট

ahmedshuvo@gmail.com

 

 

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

প্যারিসে জালালাবাদ এসোসিয়েশন ফ্রান্সের তৃতীয় সিলেট উৎসব সফলভাবে অনুষ্ঠিত

প্রকৃতির পাঠশালায় শিশুরা: ফ্রান্সের এক অনন্য উদ্যোগ

আপডেট সময় ০৫:৩৩:২৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

শাহাবুদ্দিন শুভ :: জীবনে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এমন অনেক দৃশ্য বা বাস্তবতা আমাদের সামনে আসে, যা পূর্বে কল্পনাও করিনি। তখন মনে হয় —জীবন কত বৈচিত্র্যময়, আর শিক্ষা কত গভীর ও বিস্তৃত হতে পারে। তেমনি একটি অনন্য অভিজ্ঞতা আমি ফ্রান্সে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি, যা আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছে।

আমি বর্তমানে ফ্রান্সের এক ছোট শহর Le Creusot-এ বসবাস করছি। এখানে একটি ব্যাপার আমার মন ছুঁয়ে গেছে—সাপ্তাহিক হাতে-কলমে শিক্ষা কার্যক্রম, যেখানে শিশুদের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে শেখানো হয় বাস্তব জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো। বছরে ৩/৪ দিন, এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের একটি বাগানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে এসে প্রকৃতিকে বোঝে, বাগান এবং খামারের কাজ শেখে এবং নিজের হাতে তা করে দেখে।

সাম্প্রতিক এক শুক্রবার আমি নিজে আমন্ত্রিত ছিলাম সেই বাগান পরিদর্শনের জন্য। এই প্রকল্পটি পরিচালনা করছে OPAC Saône-et-Loire নামক একটি সংগঠন, যেখানে নিয়মিত কাজ করছেন যাঁরা, তাঁদের নাম—Rénia, François, Seidath, Boubakar, Nadine, Abdou এবং Chantal । আমাকে এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছেন Justine Bénit ম্যাডাম, যিনি অত্যন্ত আন্তরিক ও শিক্ষানুরাগী একজন মানুষ। ওইদিন Le Creusot শহরের École Rosa Parks বিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ জন ছাত্রছাত্রী, যাদের বয়স ৬ থেকে ৭ বছরের মধ্যে (শ্রেণি: CP এবং CE1), বাগানে এসেছিল। তারা বছরের বিভিন্ন ঋতুতে ৩/৪ বার বাগানে আসে, যেন প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করতে পারে এবং প্রকৃতির রূপান্তর ও বৈচিত্র্য জানতে পারে।

আমি যখন তাদের বাগানে প্রবেশ করতে দেখলাম, তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠল আনন্দের ঝিলিক, ছিল একরাশ কৌতূহল। ছাত্রছাত্রীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গাছপালার পরিচর্যা শেখে। কীভাবে গাছের গোড়ায় নিড়ানি দিতে হয়, কীভাবে আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, কীভাবে গাছের যত্ন নিতে হয়—সেগুলো তাদের হাতে-কলমে শেখানো হয়। শিশুরা অকপটে ও আনন্দের সঙ্গে সেই কাজগুলো করে, কোন হেজিটেশন বা দ্বিধা ছিল না তাদের মধ্যে। এমনকি তারা নিজেদের হাতে মাটি খুঁড়ছে, গাছের পাতা তুলে নিচ্ছে, আবার কাউকে কাউকে গাছের গোড়ায় পানি দিতেও দেখা গেছে।

সবচেয়ে চমৎকার অংশটি ছিল বাগানের পাশে থাকা একটি ছোট খামার। সেখানে কিছু মোরগ এবং অন্যান্য পাখি রাখা হয়েছে। শিশুদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। তারা নিজের হাতে মোরগ ধরছে, খাবার দিচ্ছে, এবং খামারের পরিবেশ সম্পর্কে জানছে। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিশুদের মধ্যে একধরনের অনুভূতি ও ভালোবাসা তৈরি করে, যা কেবল বই পড়ে বা ছবিতে দেখে সম্ভব নয়।

আমার নিজের শৈশবও হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় বাড়ির পাশে টমেটো, বেগুন, সিম, ধনেপাতা গাছের বাগান ছিল। আমরা নিজেরা সেগুলোর পরিচর্যা করতাম, মাটি দিতাম, আগাছা তুলতাম। সেই স্মৃতিগুলো যেন হঠাৎ করে ফিরে এল, কিন্তু এবার অন্য এক ভূখণ্ডে, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে একদিকে যেমন আবেগতাড়িত করেছে, অন্যদিকে একটি প্রশ্নও জাগিয়েছে—আমরা কেন আমাদের দেশের শিশুদের জন্য এমন কিছু করতে পারি না? কেন আমাদের বিদ্যালয়গুলো এ ধরনের হাতে-কলমে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝে না? বাংলাদেশে থাকাকালে আমি চেষ্টা করেছি আমার সন্তানদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে কৃষিকাজ দেখাতে, কিন্তু তা কখনো এই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শুধুমাত্র দেখে বোঝার চেয়ে, নিজ হাতে কাজ করার মধ্যে যে আনন্দ ও শিক্ষা লুকিয়ে আছে, তা অনন্য।

এমন শিক্ষা পদ্ধতি শুধু শিশুদের জ্ঞান বাড়ায় না, বরং তাদের চরিত্র গঠনের পথ প্রশস্ত করে। তারা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, পরিশ্রমের মর্যাদা শিখে, এবং কৃষিজীবীদের প্রতি সম্মান দেখাতে শেখে। যারা একসময় কেবল শহরবাসী হয়ে বেড়ে উঠতো, তাদের মধ্যেও এই অভিজ্ঞতা একটি নতুন জানালা খুলে দেয়। ভবিষ্যতে হয়তো তাদের মধ্য থেকেই কেউ কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নেবে—ভালো লাগা আর দায়িত্ববোধ থেকে।

সবচেয়ে বড় কথা, এটি জাতি গঠনের ভিত্তি গড়তে সাহায্য করে। কারণ একটি জাতিকে সঠিকভাবে গড়তে চাইলে, শিক্ষাকে শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না—বাস্তব জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে তোলা আবশ্যক।

এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শুধু অনুপ্রাণিতই হইনি, বরং এটাও উপলব্ধি করেছি—ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এমন কার্যক্রম চালু করা কতটা প্রয়োজন। শিশুদের প্রকৃতিকে জানার সুযোগ দেওয়া মানেই তাদের জীবনের ভিত্তি আরও মজবুত করা। যদি আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতো, তবে কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ যেমন বাড়তো, তেমনি আমাদের সমাজে কৃষক শ্রেণির প্রতি সম্মানও বহুগুণে বৃদ্ধি পেত।

 

লেখক: ফ্রান্স প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট

ahmedshuvo@gmail.com