পরীক্ষামূলক প্রকাশনা | ঢাকা ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
জালালাবাদ এসোসিয়েশনের ফ্রি মেডিক্যাল সেবা বংশালে অনুষ্ঠিত গোয়ালাবাজারে গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে স্মরণ সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভেজা মাঠের কারণে বাংলাদেশ-উইন্ডিজ টেস্টের টস বিলম্বিত ‘৩-৪ আগস্ট ভারতের দালালদের সঙ্গে বৈঠকের অভিযোগ’, যা বললেন আসিফ নজরুল কুয়ালালামপুরে ১১ বাংলাদেশিসহ আটক ৩২ অভিবাসী ইতালি নেদারল্যান্ডস কানাডায় পা রাখলেই গ্রেফতার নেতানিয়াহু মালয়েশিয়ায় নিপীড়নের শিকার দুই বাংলাদেশি নারী উদ্ধার দুবাইয়ের গ্লোবাল ভিলেজে কেবল নামে আছে বাংলাদেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা মামলা থেকে মেজর হাফিজের অব্যাহতি মহাখালীতে শিক্ষার্থীদের ইট-পাটকেলে রক্তাক্ত ট্রেনযাত্রী

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন পর্যটন খেলা

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১২:৩৬:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
  • ৫২ বার পড়া হয়েছে

জামিউল আহমেদ :: সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। আয়তনের দিক থেকে এটি মাত্র আট বর্গ কিলোমিটারের একটি দ্বীপ। যার দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে প্রায় নয় কিলোমিটার। মূল ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে দ্বীপটির দূরত্ব হচ্ছে নয় কিলোমিটার। আবার মায়ানমার থেকে দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। বর্তমান জনসংখ্যা নয় হাজারের একটু বেশি। ভু-রাজনীতি এবং পর্যটন বিবেচনায় দ্বীপটির গুরুত্ব এখন তুঙ্গে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান এবং জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে থাকে। এখানে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল; ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক; ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্ত-জীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি। ভৌগলিক ভাবে এটির উত্তর পাড়ার নারিকেল জিঞ্জিরা; দক্ষিণ পাড়ার লেজের মত এলাকা এবং ১০০-৫০০ বর্গ মিটার আয়তনের ছোট্ট দ্বীপ ছেড়াদিয়া বা ছেঁড়া দ্বীপ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ এবং বিচরণ ক্ষেত্র।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে থেকেই জনবসতি শুরু হয়। এক সময় মাত্র তেরোটি পরিবার এখানে স্থায়ী নিবাস গড়েন বটে। তবে, মাত্র গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ব্যাপক হারে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ, ঐ সময় থেকে পর্যটক যাতায়াত এবং জমি কেনাবেচার সংস্কৃতি শুরু হয়।যা পরবর্তী দশকেই অনেকের দৃষ্টি কাড়ে ব্যাপকভাবে এবং দ্বীপটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে গাণিতিক হারে। যা এখন এসে বেসামাল অবস্থায় ঠেকেছে।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন মৌসুম। ঐ সময়ে প্রতিদিন ৪-৫ টি লঞ্চে করে মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকরা সেখানে যাতায়াত করে থাকেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপ তথা এখানকার মূল আকর্ষণ শৈবাল এবং জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্রসহ সার্বিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তারা প্রথম তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসে ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০১২ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণী রক্ষা আইনও প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।

কিন্তু এসব কোন উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখতে না পারার প্রেক্ষাপটে পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে দিনের বেলা পর্যটন চালু থাকবে রাতের বেলা থাকতে পারবে না; ২০২০ সালে সেন্টমার্টিন প্রবেশের ক্ষেত্রে নিবন্ধন এবং পর্যটকের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার ২৫০ জন; জাহাজে অতিরিক্ত যাত্রী না নেয়া এবং সর্বশেষ রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করা হয়। আবার ২০২১ সালে সিদ্ধান্ত হয় লঞ্চ-জাহাজে মোট যাত্রীর সংখ্যা এক হাজার ২৫০ জনের মধ্যে রাখতে হবে এবং একজন ব্যক্তি পাঁচজনের বেশি টিকিট কিনতে পারবেন না। সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রতিদিন ৮৮২ জন পর্যটক নিদিষ্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ধারাবাহিকভাবে নেয়া এসব সিদ্ধান্তের কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি।

এবার নতুন পরিবেশ উপদেষ্টা এসে হাল ধরে বলেছেন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্ল্যাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধকে সাথে রেখে আগের সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যেমন হোটেল মালিক, লঞ্চ মালিক, ট্যুর অপারেটর এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলে আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবেন। ভালো কথা কিন্তু আরেক পক্ষ পর্যটক; তাদের স্বার্থ কে দেখবে? তারপরও আমরা মাননীয় উপদেষ্টার এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই বটে। কিন্তু শঙ্কা থেকে যায় এসব সিদ্ধান্ত কি আদৌ কাজে আসবে না আগেকার মত একে একে অকার্যকর হয়ে যাবে?
অতীত অভিজ্ঞতা বলে এমন সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাবে যদিনা আরো কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় না নেয়া হয়। যেমন প্রথমেই সরকারকে আন্তরিকতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এটিকে আন্তর্জাতিক মানের একটি পর্যটক গন্তব্যে উন্নীত করা হবে কিনা।

যদি তাই হয় তবে, ভূ-রাজনীতির ‘বাঘ এলো বাঘ এলো’ এবং পর্যটকরা সব ‘নিয়ে গেলো নিয়ে গেলো’ এমন সব জুজুর ভয়কে দূর করতে হবে। তারপর অন্তত যা যা করতেই হবে তা হলো –

এক: দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন উন্নয়নের দায়িত্ব পর্যটন মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আলাদা অথবা যৌথ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

দুই: স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে তাদের পেশা অর্থাৎ মাছ ধরার বিষয়টিকে পর্যটনের একটি উপাদান হিসেবে নিতে হবে যাতে তাদের স্বার্থ আরো নিশ্চিত হয়। অবশ্য এজন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন: স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ দায়িত্বশীল পর্যটনের যে পক্ষগুলো রয়েছে তাদের অংশগ্রহণ এবং স্ব-স্ব দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করে স্থানীয় পর্যটন ব্যবস্থাপনাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।

চার: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংখ্যা এই দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটনের উন্নয়নের জন্য আদৌ কোন হুমকি কি না তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে অতিরিক্তদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাঁচ: পর্যটকের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্টেকহোল্ডার বা স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে বা কারো ইচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে দ্বীপের আয়তন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকে বিবেচনায় নিতে হবে যাতে কোন প্রশ্ন না উঠে এবং মানের দিক থেকেও ঠিক থাকে।

ছয়: বর্তমান আবাসিক এবং অন্যান্য অপরিকল্পিত স্থাপনা যা অপ্রয়োজনীয় এবং পরিবেশ ও পর্যটনের জন্য মানানসইও নয় তা সরিয়ে ফেলতে হবে; এতে কারো ক্ষতি হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও।

সাত: পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত একটি উদ্ভট চিন্তাধারা। কারণ, রাতে যদি নাই থাকে তাহলে এটিকে পর্যটক গন্তব্যই বলা যাবেনা। কেন না পর্যটক হওয়ার জন্য একজন পরিদর্শককে কম পক্ষে একরাত যাপন করতেই হয়। সেক্ষেত্রে সে পর্যটক না হয়ে সেইম ডে ভিজিটর বা একদিনের পরিদর্শক হয়ে যাবে। তাই রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ না করে এজন্য সঠিক ও সুনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আট: যেসব স্টেকহোল্ডার দায়িত্বশীল পর্যটনের আওতাভুক্ত যেমন স্থানীয় জনগোষ্ঠী, আবাসিক প্রতিষ্ঠান, খাবার ও পানীয় প্রতিষ্ঠান; জলযানসহ পর্যটন যান, ট্যুর অপারেটর এবং পর্যটক ইত্যাদি প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজনীয় ও পৃথক পৃথক আচরণ-বিধি রাখতে হবে এবং তা মানতে বাধ্য করতে হবে।

নয়: পর্যটকের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ধারণের পর তা যাতে যথাযথভাবে মানা হয়; প্রত্যেকেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব তথা আচরণ-বিধি মানতে বাধ্য হয় এবং সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় সেজন্য টুরিস্ট পুলিশকে দায়িত্ব দিতে হবে। নতুবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্য কোন বাহিনী দিয়ে হলেও তা নিশ্চিত করতে হবে।

দশ: সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটির রাস্তা-ঘাটসহ সব সাধারণ অবকাঠামো এবং পর্যটন অবকাঠামো সুপরিকল্পিতভাবে নান্দনিকতার সাথে সাজানো এবং সব পর্যটন সুবিধাদি মান সম্পন্ন ভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে শুধু সেন্টমার্টিনের জন্য একটি উন্নয় কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।

সর্বোপরি, অন্তত একাজগুলো না করা গেলে দ্বীপটির ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পর্যটনের জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ, এসব হচ্ছে বাস্তবতা যা অবহেলার বা এড়িয়ে যাবার তেমন কোন সুযোগ নেই। তা নাহলে বরাবরের মত কোন মাননীয় মন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ আর পর্যটনের জন্য সিদ্ধান্তের ঝলকানি হয়তো দেখা যাবে কিন্তু সময়ের আবর্তে তা ঠিকই আড়াল হয়ে যাবে এবং দিন শেষে কাজের কাজ কিছু হয়েছে তাও বলা যাবেনা।

চেয়ারম্যান: সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)
zamiulahmed54@gmail.com

ট্যাগস :

জালালাবাদ এসোসিয়েশনের ফ্রি মেডিক্যাল সেবা বংশালে অনুষ্ঠিত

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন পর্যটন খেলা

আপডেট সময় ১২:৩৬:০৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

জামিউল আহমেদ :: সেন্টমার্টিন। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। আয়তনের দিক থেকে এটি মাত্র আট বর্গ কিলোমিটারের একটি দ্বীপ। যার দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে প্রায় নয় কিলোমিটার। মূল ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে দ্বীপটির দূরত্ব হচ্ছে নয় কিলোমিটার। আবার মায়ানমার থেকে দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। বর্তমান জনসংখ্যা নয় হাজারের একটু বেশি। ভু-রাজনীতি এবং পর্যটন বিবেচনায় দ্বীপটির গুরুত্ব এখন তুঙ্গে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান এবং জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে থাকে। এখানে রয়েছে ৬৬ প্রজাতির প্রবাল; ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক; ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্ত-জীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি। ভৌগলিক ভাবে এটির উত্তর পাড়ার নারিকেল জিঞ্জিরা; দক্ষিণ পাড়ার লেজের মত এলাকা এবং ১০০-৫০০ বর্গ মিটার আয়তনের ছোট্ট দ্বীপ ছেড়াদিয়া বা ছেঁড়া দ্বীপ পর্যটকদের মূল আকর্ষণ এবং বিচরণ ক্ষেত্র।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে থেকেই জনবসতি শুরু হয়। এক সময় মাত্র তেরোটি পরিবার এখানে স্থায়ী নিবাস গড়েন বটে। তবে, মাত্র গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ব্যাপক হারে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারণ, ঐ সময় থেকে পর্যটক যাতায়াত এবং জমি কেনাবেচার সংস্কৃতি শুরু হয়।যা পরবর্তী দশকেই অনেকের দৃষ্টি কাড়ে ব্যাপকভাবে এবং দ্বীপটির গুরুত্ব বাড়তে থাকে গাণিতিক হারে। যা এখন এসে বেসামাল অবস্থায় ঠেকেছে।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন মৌসুম। ঐ সময়ে প্রতিদিন ৪-৫ টি লঞ্চে করে মূল ভূখণ্ড থেকে পর্যটকরা সেখানে যাতায়াত করে থাকেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপ তথা এখানকার মূল আকর্ষণ শৈবাল এবং জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্রসহ সার্বিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তারা প্রথম তাদের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসে ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০১২ সালে উদ্ভিদ ও প্রাণী রক্ষা আইনও প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।

কিন্তু এসব কোন উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখতে না পারার প্রেক্ষাপটে পর্যায়ক্রমে ২০১৯ সালে দিনের বেলা পর্যটন চালু থাকবে রাতের বেলা থাকতে পারবে না; ২০২০ সালে সেন্টমার্টিন প্রবেশের ক্ষেত্রে নিবন্ধন এবং পর্যটকের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক হাজার ২৫০ জন; জাহাজে অতিরিক্ত যাত্রী না নেয়া এবং সর্বশেষ রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করা হয়। আবার ২০২১ সালে সিদ্ধান্ত হয় লঞ্চ-জাহাজে মোট যাত্রীর সংখ্যা এক হাজার ২৫০ জনের মধ্যে রাখতে হবে এবং একজন ব্যক্তি পাঁচজনের বেশি টিকিট কিনতে পারবেন না। সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রতিদিন ৮৮২ জন পর্যটক নিদিষ্ট করার সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ধারাবাহিকভাবে নেয়া এসব সিদ্ধান্তের কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি।

এবার নতুন পরিবেশ উপদেষ্টা এসে হাল ধরে বলেছেন, একবার ব্যবহারযোগ্য প্ল্যাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধকে সাথে রেখে আগের সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যেমন হোটেল মালিক, লঞ্চ মালিক, ট্যুর অপারেটর এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলে আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবেন। ভালো কথা কিন্তু আরেক পক্ষ পর্যটক; তাদের স্বার্থ কে দেখবে? তারপরও আমরা মাননীয় উপদেষ্টার এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই বটে। কিন্তু শঙ্কা থেকে যায় এসব সিদ্ধান্ত কি আদৌ কাজে আসবে না আগেকার মত একে একে অকার্যকর হয়ে যাবে?
অতীত অভিজ্ঞতা বলে এমন সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাবে যদিনা আরো কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় না নেয়া হয়। যেমন প্রথমেই সরকারকে আন্তরিকতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এটিকে আন্তর্জাতিক মানের একটি পর্যটক গন্তব্যে উন্নীত করা হবে কিনা।

যদি তাই হয় তবে, ভূ-রাজনীতির ‘বাঘ এলো বাঘ এলো’ এবং পর্যটকরা সব ‘নিয়ে গেলো নিয়ে গেলো’ এমন সব জুজুর ভয়কে দূর করতে হবে। তারপর অন্তত যা যা করতেই হবে তা হলো –

এক: দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন উন্নয়নের দায়িত্ব পর্যটন মন্ত্রণালয়কে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আলাদা অথবা যৌথ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

দুই: স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে তাদের পেশা অর্থাৎ মাছ ধরার বিষয়টিকে পর্যটনের একটি উপাদান হিসেবে নিতে হবে যাতে তাদের স্বার্থ আরো নিশ্চিত হয়। অবশ্য এজন্য তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিন: স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ দায়িত্বশীল পর্যটনের যে পক্ষগুলো রয়েছে তাদের অংশগ্রহণ এবং স্ব-স্ব দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করে স্থানীয় পর্যটন ব্যবস্থাপনাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।

চার: স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংখ্যা এই দ্বীপটির পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটনের উন্নয়নের জন্য আদৌ কোন হুমকি কি না তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনে অতিরিক্তদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

পাঁচ: পর্যটকের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্টেকহোল্ডার বা স্বার্থসংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে বা কারো ইচ্ছার উপর ছেড়ে না দিয়ে দ্বীপের আয়তন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মকে বিবেচনায় নিতে হবে যাতে কোন প্রশ্ন না উঠে এবং মানের দিক থেকেও ঠিক থাকে।

ছয়: বর্তমান আবাসিক এবং অন্যান্য অপরিকল্পিত স্থাপনা যা অপ্রয়োজনীয় এবং পরিবেশ ও পর্যটনের জন্য মানানসইও নয় তা সরিয়ে ফেলতে হবে; এতে কারো ক্ষতি হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও।

সাত: পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত একটি উদ্ভট চিন্তাধারা। কারণ, রাতে যদি নাই থাকে তাহলে এটিকে পর্যটক গন্তব্যই বলা যাবেনা। কেন না পর্যটক হওয়ার জন্য একজন পরিদর্শককে কম পক্ষে একরাত যাপন করতেই হয়। সেক্ষেত্রে সে পর্যটক না হয়ে সেইম ডে ভিজিটর বা একদিনের পরিদর্শক হয়ে যাবে। তাই রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ না করে এজন্য সঠিক ও সুনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আট: যেসব স্টেকহোল্ডার দায়িত্বশীল পর্যটনের আওতাভুক্ত যেমন স্থানীয় জনগোষ্ঠী, আবাসিক প্রতিষ্ঠান, খাবার ও পানীয় প্রতিষ্ঠান; জলযানসহ পর্যটন যান, ট্যুর অপারেটর এবং পর্যটক ইত্যাদি প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজনীয় ও পৃথক পৃথক আচরণ-বিধি রাখতে হবে এবং তা মানতে বাধ্য করতে হবে।

নয়: পর্যটকের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ধারণের পর তা যাতে যথাযথভাবে মানা হয়; প্রত্যেকেই তার উপর অর্পিত দায়িত্ব তথা আচরণ-বিধি মানতে বাধ্য হয় এবং সার্বিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় সেজন্য টুরিস্ট পুলিশকে দায়িত্ব দিতে হবে। নতুবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্য কোন বাহিনী দিয়ে হলেও তা নিশ্চিত করতে হবে।

দশ: সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটির রাস্তা-ঘাটসহ সব সাধারণ অবকাঠামো এবং পর্যটন অবকাঠামো সুপরিকল্পিতভাবে নান্দনিকতার সাথে সাজানো এবং সব পর্যটন সুবিধাদি মান সম্পন্ন ভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে শুধু সেন্টমার্টিনের জন্য একটি উন্নয় কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে।

সর্বোপরি, অন্তত একাজগুলো না করা গেলে দ্বীপটির ঐতিহ্য ও পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পর্যটনের জন্য কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ, এসব হচ্ছে বাস্তবতা যা অবহেলার বা এড়িয়ে যাবার তেমন কোন সুযোগ নেই। তা নাহলে বরাবরের মত কোন মাননীয় মন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ আর পর্যটনের জন্য সিদ্ধান্তের ঝলকানি হয়তো দেখা যাবে কিন্তু সময়ের আবর্তে তা ঠিকই আড়াল হয়ে যাবে এবং দিন শেষে কাজের কাজ কিছু হয়েছে তাও বলা যাবেনা।

চেয়ারম্যান: সেন্টার ফর ট্যুরিজম ষ্টাডিজ (সিটিএস)
zamiulahmed54@gmail.com


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/obhibason/public_html/wp-includes/functions.php on line 5464