জামিউল আহমেদ :: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার পরপরই রব উঠলো, “সংস্কার চাই, সংস্কার” এবং হলোও তাই। প্রথমেই জরুরী ভিত্তিতে অন্তত ছয়টি বিষয়ে কমিটি হলো। তারপর হলো আরো পাঁচটি বিষয়ে। এভাবে পর্যায়ক্রমে আরো কিছু বিষয় সংস্কারের জন্য তালিকাভূক্ত হলো। এগুলোর জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও কমিটি গঠন করে দেয়া হলো। তার সাথে দেয়া হলো নির্দিষ্ট সময়সীমা।
তবে, গুরুত্বপূর্ণের মধ্যে বাদ পড়লো শুধু শিক্ষা ও পর্যটন। এনিয়ে সমালোচনাও হচ্ছিল, অন্তত মিডিয়াতে। অবশ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ সুত্র জানাচ্ছিল, এগুলো নাকি পরোবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেয়া হচ্ছে। এমন ব্যাখ্যার সত্য মিথ্যা নিয়ে কেউ খোঁজ খবর নিয়েছেন কিনা তাও ছিলো অজানা। তবে এরই মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে হৈচৈ এক পর্যায়ে রাস্তা পর্যন্ত গড়ালো। তারপর গেলো উচ্চ আদালতে। অবশ্য এতে পরিশ্রান্তরা ফলও পেয়েছেন।
তাহলে অবস্থা কি দাঁড়ালো? সরকার তার ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকিছুরই সংস্কারে হাত দিয়েছে। তবে, একেবারেই বাদ পড়ার মধ্যে রয়েছে সব সময়ের জন্য “কপাল পোড়া” এই পর্যটন। কপাল পোড়া কেনো বলতে হয়েছে তারও একটা তাফসীর বা ব্যাখ্যা দরকার। তবে এই ব্যাখ্যা দিতে হলে অন্তত মোটা দাগেই হোক বাংলাদেশে পর্যটনের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কিছুটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং বা সত্যানুসন্ধান করে দেখাতে হবে।
বাংলাদেশে পর্যটনের শুরুটা বলতে গেলে অনেকটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। কেন না বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পর ভাত-কাপড়, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, দেনা-পাওনা ইত্যকার বিষয়গুলোই ছিল জরুরী এবং প্রধান বিবেচ্য। এমতাবস্থায় সেই পাকি আমল থেকে যাত্রা শুরু হলেও অনেকটা অজানা-অচেনা একটি বিষয় হিসেবে “পর্যটন” উন্নয়নের বিবেচনায় এসে যাওয়াটা ছিলো সত্যিই একটা চমক। অবশ্য এর মূলে কাজ করেছিল পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনার বিষয়টি।
তারপর দেখতে দেখতে তিপান্ন বছর কেটে গেলো। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়ালো। কিন্তু পর্যটনের ভাগ্যের চাকা আর ঘুরলোনা। একের পর এক সরকার এলো আর গেলো। তার সাথে পর্যটনের যাত্রা শুরুর সেই “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন”; পরোবর্তীতে “বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়” এবং সর্বশেষ “বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড” সবই হলো। হলোনা শুধু অপার সম্ভাবনাময় পর্যটনের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন।
সার কথা, এই তিপান্ন বছরে পর্যটন নিজে যা পাবার তা সে পায়নি। তবে, পর্যটন থেকে অনেকেই যে অনেক কিছু পেয়েছেন তা স্বীকার করতেই হবে। ব্যাপারটাকে যদি আমরা স্রেফ সাদামাটাভাবেও নজরে আনি তাহলে কি দেখতে পাই? কি সরকারি কি বেসরকারি উভয় খাতের সবারই কমবেশি প্রাপ্তির যোগ ছিল। তবে, সরকারি খাতের প্রাপ্তিটা ছিলো অস্বাভাবিকভাবে বেশি। যেজন্য সার্বিক বিচারে ব্যাপারটি এখন পরিষ্কার করার প্রয়োজন রয়েছে।
একঃ সরকারি খাত
(ক) রাজনৈতিক সরকারঃ অনেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়েছেন; দেশ-বিদেশ সফর করেছেন; বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন; প্রধানমন্ত্রীরা বিভিন্ন দেশ সফরে গিয়ে অন্য দেশের সাথে পর্যটন নিয়ে “সমঝোতা স্মারক” স্বাক্ষর করে বাহবা কুড়িয়েছেন বটে কিন্তু এগুলোর একটিও আজ পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়নি; এই করবো সেই করবো বলে ফাঁকা বুলি দিয়েছেন এবং সর্বোপরি সব কয়টি সরকারই পর্যটন নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে এবং তাদের মন্ত্রীরাও জেলে গেছেন।
(খ) প্রশাসনিক সরকারঃ সচিব, অতিরিক্ত-সচিব, যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিব, সহকারী-সচিব ইত্যাদি বড় বড় পদে আমলারা বসার সুযোগ পেয়েছেন; চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক ইত্যাদি বড় বাবুরা চেয়ার পেয়েছেন; কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকুরীর সুযোগ পেয়েছেন; অনেকেই দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন; অনেকে আবার দুর্নীতির মাধ্যমে ফায়দা লুটার সুযোগ পেয়েছেন এবং জেলেও গিয়েছেন।
(গ) লাইসেন্স ফি ও কর বাবদ প্রাপ্ত অর্থঃ হাজার হাজার হোটেল, মোটেল, গেষ্ট হাউজ, রিসোর্ট ইত্যাদি আবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্স ফি; ট্যুরিস্ট ভেহিকল এবং ওয়াটার ভেসেল থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্স ফি; রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড, ফুডকোর্ট, কফি শপ, পাব ও গেষ্ট্রো পাব, ক্লাব ইত্যাদি খাবার ও পানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্স ফি ও কর এবং শত শত ট্র্যাভেল এজেন্সি ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান থেকে লাইসেন্স ফি বাবদ মোটা অংকের অর্থ প্রাপ্তি হয়েছে।
(ঘ) পর্যটকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থঃ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে বিভিন্ন স্থাপনার প্রবেশ ফি; পর্যটন যান, আবাসন এবং খাবার ও পানীয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাপ্ত মোশক ও কর ইত্যাদি বাবদ অর্থ প্রাপ্তি হয়েছে।
(ঙ) বিবিধঃ অন্যান্য মন্ত্রণালয় এবং সরকারি বিভাগ যেমন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর ইত্যাদি যাদের সাথে পর্যটনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের বিভিন্ন স্থাপনা ও সংরক্ষিত এলাকার প্রবেশ ফি, উন্নয়ন অনুদান ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ এবং এনজিও ও বিদেশি দাতা সংস্থার মাধ্যমে অনুদান ইত্যাদি যা পাওয়া গেছে।
দুইঃ বেসরকারি খাত –
(ক) ভ্রমণের সুযোগঃ পর্যটনের বদৌলতে যাই বা যতটাই থাকুক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে।
(খ) শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের সুযোগঃ মানের দিক থেকে যাই হোক পর্যটনকে শিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের জন্য কাজে লাগানোর বিশেষ সুযোগ পাওয়া গেছে।
(গ) ব্যবসার সুযোগঃ সত্যিকার পর্যটন উন্নয়নকে উদ্দেশ্য করে হোক আর স্রেফ ব্যবসার জন্যই হোক পর্যটনের প্রতিটি খাত ও উপ-খাত ভিত্তিক ব্যবসাকে অবারিল সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে।
(ঘ) চাকুরীর সুযোগঃ পরিসংখ্যানে যতই ত্রুটি থাকুক তারপরও এটি অস্বীকার করা যাবেনা যে লক্ষ লক্ষ পর্যটন কর্মী এবং শত শত শিক্ষক ও প্রশিক্ষক এই পর্যটনের বিভিন্ন স্তরে চাকুরীর সুযোগ পেয়েছেন।
(ঙ) সমিতি ও নেতৃত্বের সুযোগঃ অনুমোদন প্রাপ্ত অথবা অনুমোদনহীন যাই হোক পর্যটন বিষয়ক অসংখ্য সমিতি গঠন এবং এগুলোতে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন।
এভাবে এই দীর্ঘ সময়ের এসব প্রাপ্তিকে এক করলে তা যে বিশাল এবং ব্যাপক কিছু হবে এটি মানতেই হবে। কিন্তু বিপরীতে সম্ভাবনার পর্যটন কি পেলো? পেয়েছে এতক্ষণ যা বয়ান করা হলো তা অন্যের নামে এবং হিসাবে। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য হলো পর্যটন নিজের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য আজ পর্যন্ত যেসব মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারেনি তার তালিকাও কিন্তু নেহায়েত কম দীর্ঘ নয়।
এর মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণ পৃথক ও শক্তিশালী মন্ত্রণালয়; গতিশীল নেতৃত্বদানে সক্ষম মন্ত্রী; সরকার প্রধানের সরাসরি নেতৃত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা; গতিশীল ও কার্যকর প্রশাসন/কর্তৃপক্ষ; আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা নিরসন; সঠিক এবং কার্যকর পরিককল্পনা প্রণয়ন; প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ; প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন; শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিতকরণ; পর্যটন সম্পদ চিহ্নিতকরণ; পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণন; মানসম্পন্ন পর্যটন সেবা বা কিউ টি এস; মানসম্পন্ন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ; গবেষণা ও জাতীয় পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার; পর্যটন পরিসংখ্যান তথা ট্যুরিজম সেটেলাইট একাউন্ট (টিএসএ); বেসরকারি খাতের সাথে আইনি সম্পর্ক এবং যোগ্যদের সম্মাননা দেয়া ও যথাস্থানে কাজে লাগানো ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হলো এত এত অপ্রাপ্তি যা আজ পর্যন্ত পর্যটনকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা অবস্থায় রেখেছে তার পেছনের মূল রহস্যটা কি? খুঁজতে গেলে হয়তো অনেক কিছুই পাওয়া যাবে এবং যাচ্ছেও। তবে, সার্বিক বিচারে এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে যা তাহলো “অবহেলা” নামের একটি অনুষঙ্গ। এই অবহেলাই হচ্ছে মূল হোতা বা কারিগর যে সব সময় অমিত সম্ভাবনার পর্যটনকে পিছিয়ে রাখতে দায়িত্ববান সবাইকে ইন্ধন যুগিয়েছে।
তাহলে প্রথমেই দেখা যাক এই অবহেলা ব্যাপারটা আসলে কি? যার কিনা এত ক্যারিশমা তথা চৌম্বকীয় আকর্ষণ এবং যে সবাইকে হিপনোটাইজড বা সম্মোহিত করে রাখতে পেরেছে। অবহেলার বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে – উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অযত্ন, অমনোযোগ ইত্যাদি। আবার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে নেগলিজেন্স যা ল্যাটিন নেগলিজেনশিয়া শব্দ থেকে আগত। অর্থ হচ্ছে “একই পরিস্থিতিতে যথাযথ যত্ন গ্রহণে ব্যর্থতা যা প্রত্যাশিত”। তাহলে দেখা যাচ্ছে সাধারণ অর্থে অবহেলা হলো, কোনো বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়া বা অগ্রাহ্য করা।
পর্যটনের জন্য এই অবহেলা অনুষঙ্গটি এতটা প্রকট যে অনেক সময় আন্তরিকতা কিংবা ইচ্ছা থাকার পরও গুরুত্বের ঘাটতি থাকায় ঘোষণা দিয়েও সরকারগুলো অনেক কিছু বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যেমন সরকার পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে বটে কিন্তু এই শিল্পের মধ্যে কোন কোন খাত রয়েছে কিংবা শিল্প সহায়ক সুবিধাগুলো কি কি তা চিহ্নিত করতে পারেনি। আবার পর্যটন নীতিমালা করেছে বটে কিন্তু তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে চীনের সাথে অনেক কাঠ খড়ি পুড়িয়ে “এপ্রোভড ডেস্টিনেশন ষ্টেটাস” বা এডিএস স্বাক্ষর করেছে কিন্তু তা কাজে লাগাতে বা ক্যাশ করতে পারেনি।
আবার একক পর্যটন আইনের খসড়া চুড়ান্ত করে ঘোষণা দিয়েও তা আইনে পরিণত করতে পারেনি। পারেনি “থ্রাস্ট সেক্টর” ঘোষণা দিয়েও পর্যটনকে অগ্রাধিকার দিতে। তেমনি পারেনি সরকার প্রধানকে নেতৃত্বে নিয়ে আসতে; পৃথক ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয় করতে; পর্যটন পণ্যের উপর ভিত্তি করে গোটা দেশে পর্যটনের দশটি প্রশাসনিক অঞ্চল করতে; অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজে লাগাতে। এভাবে বহু ব্যাপার উল্লেখ করা যাবে যা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। তার মূলে কাজ করেছে এগুলো আন্তরিকতার সাথে সমাপ্ত করার ক্ষেত্রে চরম অবহেলা বা খামখেয়ালিপনা।
অন্যদিকে প্রশাসনিক সরকার তথা আমলাতন্ত্রের অবহেলা যতটানা শিল্পের প্রতি তার চেয়ে অধিক অন্যদের এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতের প্রতি। কেন না তারা মনে করে পর্যটন হচ্ছে তাদের নিজেদের ধারণাপ্রসূত নিয়ম যার সাথে অন্যের মুনশিয়ানা বা অংশীদারিত্ব মেনে নেয়ে যাবেনা। অথচ গোটা দুনিয়ায় পর্যটন চলে পর্যটনের প্রতিষ্ঠিত নিয়মে। এতে করে নিছক তাদের মনের মত না হওয়ায় অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা বাগড়া দিয়েছে। যেজন্য প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র কর্তৃক কোনো বিষয় বা ব্যক্তিকে গুরুত্ব না দেয়া বা অগ্রাহ্য করার তালিকাও কিন্তু বেশ দীর্ঘ।
এর মধ্যে উপরে বর্ণিত সবগুলো বিষয়তো রয়েছেই। তার সাথে যোগ করা যায় “একক পর্যটন আইন” এবং পর্যটনের “প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ” যা সরাসরি ঠেকিয়ে দেয়া। একইভাবে পর্যটনের জন্য অন্তত স্বল্প মেয়াদী হলেও যে পরিকল্পনা দরকার তা এড়িয়ে নিজেদের মত করে পর্যটন কর্মকাণ্ড চালানো। এছাড়াও পর্যটন সম্পদ চিহ্নিত করে স্তরীকরণের মাধ্যমে অগ্রাধিকার নিরূপণ এবং পণ্যের উন্নয়ন না করে নিজেদের পছন্দে সেকেলে ও গতানুগতিক বিপণন কার্যক্রম চালানো। এমনকি আজ পর্যন্ত “পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার” ও “গবেষণা কাজ” ছাড়াই স্রেফ অনুমান নির্ভর হয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে পর্যটনকে গতিহীন করে রাখা। এরকম অসংখ্য বিষয়ে নিজেদের একক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার পিছনে কাজ করেছে একদিকে পর্যটনের প্রতি এবং অপরদিকে অন্যদের প্রতি অবহেলা।
এদিকে বেসরকারি খাতের অবহেলার গতি-প্রকৃতি আবার অন্য ধরণের। এখানে সর্বত্র পর্যটন জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে পেশাগত কাজ চালানোর একটা প্রবণতা সুস্পষ্ট। যা কিনা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ, জ্ঞান আহোরণ, পর্যটন চর্চা, লেখালেখি, প্রচার কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় সর্বত্র বিরাজমান। অথচ পর্যটনের মত একটি অত্যাধূনিক ও গতিশীল শিল্পের সাথে তা মোটেও যায়না। উপরন্তু এতে পর্যটন থেকে সর্বোচ্চটা প্রাপ্তির সুযোগটাও হাতছাড়া হয়েছে। যার পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করেছে ঐ অবহেলার মত অনুষঙ্গটি। ফলশ্রুতিতে এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে সার্বিক সেবার গুণগত মানের উপর।
এমনকি যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ কিংবা ন্যুনতম নজরদারীর অনুপস্থিতি এই পুরো সেবাখাতটিকে একদিকে অরক্ষিত এবং অন্যদিকে অভিভাবকহীন করে রেখেছে। অথচ পর্যটনে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই। এগুলোর অনুপস্থিতি তথা কালো ছায়ার প্রভাব পর্যটনের পেশাগত ও ব্যবসায়ীক সমিতিগুলোকে প্রায় অকেজো করে রেখেছে। যেজন্য পারষ্পরিক অবজ্ঞা আর অবহেলার এক পরিবেশ কার চেয়ে কে ক্ষমতাবান কিংবা কোন সমিতির উপরে কোন সমিতি ইত্যকার অসুস্থ প্রতিযোগীতা এবং অহমের জন্ম দিচ্ছে। এতে করে সব স্টেকহোল্ডার বা দায়কগোষ্ঠী একত্রিত হয়ে ন্যায্য দাবী-দাওয়া নিয়ে এক সুরে কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতেও পারছেনা।
অন্যদিকে পর্যটনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের বাইরেও আরো অনেকে রয়েছেন যারা পর্যটনের সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত। তাদেরও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এই শিল্পের প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অন্তত নৈতিকভাবে হলেও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেমন ২০০৪ সাল থেকে পর্যটনের বিশ্ব মুরুব্বী “জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা” বা ইউএনডাবলুটিও গণমাধ্যম তথা মিডিয়াকে পর্যটনের তৃতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমন কি “রেসপনসিভল ট্যুরিজম” বা দায়িত্বশীল পর্যটনের একটি পক্ষ হিসেবেও নিয়েছে। তারপরও প্রিন্ট কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কোনটিতেই পর্যটন নিয়ে তেমন কোন প্রচার-প্রচারণা বা তৎপরতা নেই বললেই চলে। এর মূলেও কাজ করছে এই অবজ্ঞা তথা অবহেলার মত অনুষঙ্গটি। অথচ শতভাগ সেবা নির্ভর শিল্প হিসেবে পর্যটনের প্রচার ও প্রসারে মিডিয়াই হচ্ছে প্রধান এবং নির্ভরযোগ্য মাধ্যম, যার কোন বিকল্প নেই।
একইভাবে পর্যটনের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। এর মধ্যে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ব, প্রত্নতত্ব, বিপণন, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, পরিবেশ, প্রযুক্তি, স্থাপত্য, সাহিত্য ইত্যাদি সরাসরি পর্যটনের সাথে জড়িত। তাই এদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে পর্যটনের জন্য অনেক কিছু দেয়ার রয়েছে। তবে, এদের মধ্য থেকে যদি গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে শুধু অর্থনীতিবিদদের ভূমিকার দিকে দৃষ্টি ফেলা যায় তাহলে আমরা কি দেখবো? তারা যেনো মুখে এঁটেছেন কলুপ আর কলম রেখে দিয়েছেন পকেটে। নাহয় দেশের উন্নয়ন নিয়ে সত্যিকারভাবে ভাবলে এবং ভিশন ও মিশন তথা লক্ষ্য ও করণীয় সুনির্দিষ্ট থাকলে পর্যটনকে তারা এভাবে অবহেলায় ফেলে রাখতে পারতেন না। কারণ, পর্যটনের যেমনি রয়েছে অমিত সম্ভাবনা তেমনি পর্যটন থেকে নীট মুনাফাও আসে সবচেয়ে বেশি।
সর্বোপরি খোদ রাষ্ট্র এবং সরকারই আজ পর্যন্ত পর্যটন নিয়ে যে আন্তরিক নয় তাও সুস্পষ্ট। যেমনটি বলা যায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আর নাহয় সরকার বিষয়ভিত্তিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, কৃষি-প্রযুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয়ে অবদানের এবং শ্রেষ্টত্বের মূল্যায়ন করে থাকে নানাভাবে পুরষ্কৃত করে কিংবা সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে। অথচ আজ তিপান্ন বছর পরও এই পর্যটন শিল্প কিংবা শিল্প সম্পৃক্ত কারো ভাগ্যে এমন কিছু জুটেনি। তাহলে কি এই শিল্পের কোন অবদান নেই? নেই কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যারা পুরষ্কৃত বা সম্মানিত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? অবশ্যই পর্যটনের অবদান আছে এবং যোগ্য ব্যক্তিবর্গও আছেন। নেই শুধু ন্যায় বিচার এবং আন্তরিকতা। আছে শুধু অবহেলা আর অবহেলা।
এভাবে দীর্ঘদিন ধরে পর্যটনের প্রতি অবজ্ঞা আর অবহেলার যে লিগেসি তথা প্রচ্ছন্ন প্রভাব তা থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও মুক্ত থাকতে পারেনি। পারেনি বলেই পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন উপদেষ্ঠা ও একজন সচিব পাওয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছিলো। এক পর্যায়ে সংস্থাপন মন্ত্রণায় থেকে পদোন্নতি দিয়ে এক ভদ্রমহিলাকে এনে সচিবের কেদারায় বসানো হলো বটে। কিন্তু উপদেষ্ঠা পাওয়া গেলোনা বিধায় পর্যটন মন্ত্রণালয় থাকলো স্বয়ং প্রধান উপদেষ্ঠার কাছে। তখনো এই অবহেলার জেরে পর্যটনের পক্ষ থেকে কেউ সোচ্চার হলোনা, কোন দাবীও উঠলোনা।
এক পর্যায়ে আমি নিজ উদ্যোগে পর্যটনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারসহ প্রধান প্রধান দাবীগুলো বিস্তারিতভাবে আবেদন আকারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্ঠা বরাবর পাঠালাম। অবশ্য এর কয়েকদিনের মধ্যেই একজন উপদেষ্ঠাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পর্যটন মন্ত্রণায় দেয়া হলো। তবে, দুর্ভাগ্যবশত কিছুদিনের মধ্যে এই উপদেষ্ঠাও পরোপারে চলে গেলেন। এদিকে আবার এই অভিবাবকহীনতার সুযোগে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সুযোগ্য উপদেষ্ঠা পরিবেশ রক্ষার নামে সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে তার খড়গহস্ত প্রসারিত করে রেখেছিলেন। তখনো এই পর্যটনের ব্যাপারে এখানকার সবাই যেনো ঐ অবহেলা তথা অবজ্ঞাবশতই নীরবতা পালন করছিলেন।
তবে, আমি নীরব থাকতে পারিনি বিধায় ঐ সময় কলম ধরে সুনির্দিষ্টভাবে দশ দফা প্রস্তাব রেখেছিলাম। ঐ প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক ছিলো বলেই এর মধ্যেকার অন্তত ছয়টি মেনেও নেয়া হয়েছিলো। হয়তো চাপ থাকলে বা দেনদরবার করা গেলে বাকীগুলোরও একটা সুরাহা হয়ে যেতো। কিন্তু ঐ অবহেলাই বিষয়টাকে জিয়িয়ে রাখলো। তারপরও খবর হলো স্থানীয় সরকার বিষয়ক সংস্কার কমিটি স্থানীয়ভাবে আয় বাড়ানোর জন্য পর্যটন এলাকায় “পর্যটন কর” আরোপের প্রস্তাব রেখেছে। তা হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি, যেহেতু ঐ কপাল পোড়া পর্যটনের হয়ে কথা বলার কেউ নেই।
সর্বশেষ যা উল্লেখ করার মত তা হলো, ঢাকায় ৮ থেকে ১১ এপ্রিল ২০২৫ এই চারদিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে যে সম্মেলন হয়ে গেলো তাতে ৫০ টি দেশের প্রায় ৫৫০ জন বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করেছিলেন। জমজমাট এই সম্মেলনে যে পাঁচটি খাত অগ্রাধিকার পেয়েছিল তার মধ্যে পর্যটন ছিলোনা। এমন কি কোন আলোচনায়ও “কপাল পোড়া” পর্যটন ছিলোনা। অথচ এই সম্মেলনের আয়োজক যে “বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ” বা বেজা তারাই পর্যটনে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিগত ২০১৬ সালে অন্তত তিনটি পর্যটন পার্ক নির্মানের কাজ শুরু করেছিলো। যা কিনা এই নয় বছরেও আলোর মুখ দেখতে পারেনি।
এই পার্কগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ৯৬৭ একর জমিতে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, ২৭১ একর জমিতে নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমিতে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এর মধ্যে বিদেশি বিনোগকারী আকর্ষণের লক্ষে শুধু সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চার বছরে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিলো। এমনকি ২৬ জন বিনিয়োগকারীকে ১১৯.৭৯ একর জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। আর বিনিয়োগের প্রস্তাবও নাকি এসেছিলো ৪২১ মিলিয়ন আমেরিকান ডলারের। কিন্তু তারপর যা হবার তাই হয়েছে; তবে এজন্য যথারীতি সরকার এবং আমলাতন্ত্রের অবহেলাকে দায়ী করা হচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও অবহেলা জয়যুক্ত।
অতএব, “অবহেলায় পর্যটন” নিয়ে আলোচনা আর দীর্ঘ না করে শেষ কথা বলে নেয়াই ভালো। আর তাহলো “ট্যুরিজম ইজ এভরিবডিজ বিজনেস” অর্থাৎ পর্যটন কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নয়; পর্যটন সবার। তাই এই পর্যটন বাক্যটিকে আমলে নিয়ে পর্যটন সম্পৃক্ত সকল পক্ষ তথা সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের সকলকে যার যার অবস্থান থেকে যে কোন প্রকার জড়তা, অবজ্ঞা, অবহেলা ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেন না একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠান কিংবা একটি মাত্র খাতের জন্য গোটা পর্যটন শিল্পই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যেতে পারে। তাই আর অবহেলা নয় বরং একাট্টা হয়ে তথা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসে দায়িত্ব পালন করতেই হবে। নাহয় পর্যটনের এই বন্ধ্যাত্ব কাটবেনা এবং উন্নয়ন ও বিকাশের ধারায়ও ফিরে আসতে পারবেনা, এটি প্রায় নিশ্চিত।
লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)।