পরীক্ষামূলক প্রকাশনা | ঢাকা ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নের রূপরেখা

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৭:৪৭:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫
  • ১৫ বার পড়া হয়েছে

জামিউল আহমেদ : সাধারণ অর্থে ভ্রমণ বিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড কে বলা হয় পর্যটন। তাই পর্যটনের পরিধি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। পর্যটনকে অনেকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

 

পর্যটন কি

সাধারণ অর্থে ভ্রমণ বিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড কে বলা হয় পর্যটন। তাই পর্যটনের পরিধি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। পর্যটনকে অনেকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মধ্যে “জাতিসংঘ বিশ্ব  পর্যটন সংস্থা” বা ইউ এন ডাবলু টি ও (UNWTO)-এর দেয়া সংজ্ঞাটি এখন বিশ্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারও করা হচ্ছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী পর্যটন হচ্ছে, “মানুষের এমন সব কর্মকাণ্ড যা তাদের স্বাভাবিক বসবাসের স্থান থেকে অন্য কোন নতুন স্থানে অবসর বিনোদন,  ছুটি কাটানো, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, ধর্ম ইত্যাদি কারণে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া ব্যতিরেকে কমপক্ষে একদিন কিন্তু তিনশত পয়ষট্টি দিনের কম সময়ের জন্য ভ্রমণের সাথে সম্পৃক্ত”। সজ্ঞাটিতে বর্ণিত ভ্রমণ সম্পৃক্ত এসব কর্মকাণ্ড  যেগুলোকে আমরা ব্যাপক অর্থে কর্মযজ্ঞ বলতে পারি তাই হচ্ছে পর্যটন তথা এই শিল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি। তাই এসব কর্মকাণ্ড  একদিকে মানুষের বিষয়ভিত্তিক ভ্রমণকে করে আরো নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক এবং অন্যদিকে পর্যটন থেকে আয়ের পথকে করে আরো সুগম ও সমৃদ্ধ।

পর্যটন কেন

মানুষ যখন থেকে ভ্রমনে বেরিয়েছে তখন থেকেই ভ্রমণ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। তবে, বিশেষ করে পর্যটন যখন থেকে মানুষের ভ্রমণকে আরো গোছালোভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে তখন থেকেই তা একটি আকর্ষণীয় ব্যবসার মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। পরবর্তীতে এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পর্যটন গোটা বিশ্বে নানাভাবে মানুষের জীবন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে অবদান রেখে চলেছে। তাহলে পর্যটনের এসব অবদান কি মানুষ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে?  অবশ্যই পারছে এবং পর্যটন থেকে এসব প্রাপ্তির মধ্যে যা যা উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে রয়েছে –

  • ভ্রমণকে আরো বেশি কার্যকর, উপভোগ্য, ঝুঁকিমুক্ত, সাশ্রয়ী ও বহুমাত্রিক করা।
  • গন্তব্য, আকর্ষণ, দর্শণীয় স্থান, ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি আরো ভালোভাবে দেখা, জানা এবং তা থেকে শেখার সুযোগ পাওয়া।
  • শিক্ষার বাহন তথা হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো।
  • পর্যটকদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি।
  • বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি।
  • মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি।
  • টেকসই পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সার্বিকভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা।
  • পরিকল্পিতভাবে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণ এবং লালন নিশ্চিত করা।
  • ধর্মীয় কর্মকাণ্ড  যেমন তীর্থযাত্রা, ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
  • সামাজিক বন্ধন, আঞ্চলিক সহযোগীতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা।

এছাড়াও উল্লেখ করার মত পর্যটনের আরো অনেক অবদান রয়েছে। তারপরও যা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকেই বুঝা যায় পর্যটন কেন এবং বর্তমানে এর অবস্থান কোথায়। পর্যটনকে ব্যবহার করে আজ অনেক জাতি এবং দেশ উন্নয়নের মুখ দেখতে পেরেছে। আবার অনেক দেশের প্রধাণ আয়ের উৎস হচ্ছে এই পর্যটন। এমন কি অনেক স্বল্পোন্নত দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধাণ কয়েকটি উৎসের মধ্যে রয়েছে এই পর্যটন। এজন্য আজকাল দুনিয়া জুড়ে পর্যটনের জয়জয়কার। আর তাই জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বা ইউ এন ডাবলু টি ও (UNWTO) বলেছে, “পর্যটন ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং গোটা বিশ্বের সমৃদ্ধি আনে”।

বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা 

বাংলাদেশ তার ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, মাটি ও মানুষ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বে গর্ব করতে পারে এমন বিরল দেশগুলোর একটি। কেন না প্রকৃতি দেশটিকে অপার দিয়েছে যা শুধু দেখলেই কেবল বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। সমতল ভূমি থেকে শুরু করে টিলা-পাহাড়, বন-বনাঞ্চল, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, সমুদ্র এবং দ্বীপ কি নাই এই দেশটিতে। তার সাথে যোগ হয়েছে সহজ-সরল গ্রামীণ সমাজ ভিত্তিক হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর শহুরে জীবন ব্যবস্থা। তাই এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে টানার জন্য রয়েছে যথেষ্ট উপকরণ। অবশ্য মানবসৃষ্ট তেমন একটা না হলেও অন্তত প্রকৃতি প্রদত্ত পর্যটক আকর্ষণ বহুকাল থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটক গন্তব্য হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তারপর কালের বিবর্তনে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন আরো অনেক পর্যটক আকর্ষণ। এগুলো যথাযথ উন্নয়নের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন পর্যটন পণ্য। যার উপকরণ তথা যোগানদার হিসেবে কাজ করেছে আমাদের সাগর, সৈকত, দ্বীপ, নদী, বিল, জলাশয়, হাওর, লেক, পাহাড়, বনাঞ্চল, গ্রাম-বাংলা, প্রত্ন সম্পদ, স্থাপত্যশৈলী, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, আদিবাসী, ধর্ম, ক্রীড়া, বিনোদন এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি।

এসব উপকরণ বা পর্যটন সম্পদ ব্যবহার করে আধুনিক ও প্রতিযোগীতামূলক পর্যটন বাজার উপযোগী নতুন নতুন পর্যটন পণ্য সৃষ্টি তেমন কোন ব্যাপারই নয়। কারণ, আজকাল পর্যটন পণ্যকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটকদের যাই আকৃষ্ট করানো যায় তাই কোন না কোন পর্যটন পণ্য হিসেবে পর্যটন বাজার দখল করে বসে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইদানীংকালে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে হালাল ট্যুরিজমকে অনেকটাই শীর্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব বিবেচনায় আমাদের যেসব পর্যটন উপকরণ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা প্রচুর। কেন না শুধু ইচ্ছাশক্তি এবং আন্তরিকতা থাকলে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার পর্যটন সম্পদের সাথে পর্যাপ্ত ও সহজলভ্য মানব সম্পদ থাকায় এসব পর্যটন উপকরণ পর্যটন পণ্যে রূপান্তর করে পর্যটন উন্নয়নকে তরান্বিত করা কোন ব্যাপারই নয়।

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নে অন্তরায়

প্রযুক্তির বদৌলতে আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থাপনা এগিয়ে যাচ্ছে অনেকটাই দুর্বার গতিতে। যেজন্য গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন পণ্য আর বেগবান হচ্ছে প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থা। তাই এখন সেই সনাতনী বা প্রচলিত এবং নামিদামী পর্যটক গন্তব্যগুলো মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে যদি সে তার পর্যটন পণ্য সম্পর্কে পর্যটকদের ধারণা দিতে এবং আকৃষ্ট করতে না পারে। অর্থাৎ পর্যটকদের কাছে এখন কোন বিশেষ গন্তব্যই শুধু আকর্ষণের বিষয় নয় যদি না ঐ আকর্ষণের ধরণ এবং সেবার গুণগত মান তাকে আকৃষ্ট করে। কেন না পর্যটকরা এখন এটা খুব ভালো করেই জানে যে বাড়ি ফেরার সময় আর কিছুই নয় বরং শুধু ঐ সন্তুষ্টিটুকুই থাকে তার সাথে। তাই আজকাল পর্যটকরা খুবই সচেতন বিধায় পর্যটন পণ্যের ব্যাপারে তারা কোন ছাড় দিতে একেবারেই নারাজ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পর্যটন পণ্যগুলো একেবারেই সেকেলে এবং প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থার অনুপযোগী।

কেন না পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটক আকর্ষণগুলো চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ এবং মান উপযোগী করে উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার তা নানা কারণে আমরা করতে পারছি না। তার সাথে পর্যটক সেবা এবং সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করাতো যাচ্ছেইনা উপরন্তু দিন দিন নানা সমস্যা জঞ্জালের মত শুধু স্তুপাকার হচ্ছে আর আমরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছেঃ  স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয় না থাকা; যথাযথ পর্যটন তথা প্রশাসনিক কাঠামোর অনুপস্থিতি; আধুনিক ও বাস্তব সম্মত পর্যটন ব্যবস্থাপনার অভাব; অসুস্থ রাজনীতি; আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা; বেসরকারি খাতের অনৈক্য ও নির্লিপ্ততা; পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়া; যথাযথ পরিকল্পনা না থাকা; বাজেট বরাদ্দ না থাকা; পণ্য চিহ্নিতকরণ না হওয়া; সেবার মান নিয়ন্ত্রণ না করা; শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত না করা; বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না করা; আইন প্রণয়ন না করা; মান সম্পন্ন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করা; সাধারণ অবকাঠামো ও পর্যটন অবকাঠামোর উন্নয়ন না করা; ভাবমূর্তী উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেয়া; সমন্বয় না করা; ব্যাপক ভিত্তিক প্রচার-প্রচারণা ও কার্যকর বিপণন নিশ্চিত না করা; নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা; পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার সৃষ্টি ও তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না করা; সঠিক পরিসংখ্যান না থাকা; পর্যটন গবেষণা কাজের অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি সরকার প্রধান কর্তৃক সার্বিক পর্যটন উন্নয়নে পৃষ্টপোষকতা ও নেতৃত্ব না দেয়ার মত বিষয়গুলো।

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পর ১৯৭২ সালে “বাংলাদেশ পর্যটন কপপোরেশন” (বাপক) অধ্যাদেশ-এর মধ্য দিয়ে পর্যটন তার যাত্রা শুরু করে। প্রথম দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন যে আঙ্গিকে ও গতিতে তার পথ চলা শুরু করেছিল তা এক সময় ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। একের পর এক সরকার ক্ষমতায় এসে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই অন্য সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোকে পাশ কাটিয়ে স্রেফ নিজেদের পছন্দমত পদক্ষেপ নেয়াতে পর্যটন উন্নয়নে যতটুকুইবা কাজ হয়েছিল তা ধারাবাহিকতা ও সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তবে এটা স্বীকার্য যে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সাধারণ মানুষকে পর্যটনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করা, পর্যটন সেবার সাথে পরিচিত করা, পর্যটনকে একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া, পর্যটন শিল্প উপযোগী মানব সম্পদ তৈরী করা এমন কি পর্যটন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা ইত্যকার কাজগুলো বেশ সফলতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রশাসনিক জঠিলতার আবর্তে পড়ে এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সে ধারাবাহিকতা ও আবহ খুব একটা বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। কেন না ১৯৯২ সালে পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন এবং পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করা হলেও তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। এজন্য সবচেয়ে বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়িত না হওয়া এবং শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত না করার মত বিষয়গুলো।

পরবর্তীতে পর্যটন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষে ২০১০ সালে পর্যটন নীতিমালা পুন:প্রণয়ন এবং “বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড” (বিটিবি) গঠনও তেমন একটা সফলতা আনতে পারেনি। কেন না সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়ন হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড-কে জনবল, অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবের মধ্যে রেখে পর্যটন উন্নয়ন ও প্রচারের সার্বিক দায়িত্ব দেয়াও তেমন কোন কাজে লাগেনি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ জনবল, সম্পদ, অভিজ্ঞতা, পরিচিতি যে বাংলাদেশ পর্যটন কপপোরেশন-এর কাছে রক্ষিত ছিল তাকে স্রেফ ব্যবসা-বাণিজ্যের আবর্তে ফেলে দেয়াতে পুরো পর্যটন কাঠামোই একটা অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। কেন না গোটা দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত যে ৩০-৩৫ টি দেশে তাদের পর্যটন বোর্ড কাজ করছে সেগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কর্মপরিধি পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের এই দুর্বল অবস্থান পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। এতে করে একদিকে দুর্বল ও অস্পষ্ট পর্যটন কাঠামো; অন্যদিকে যুগোপযোগী ও টেকসই পরিকল্পনা না থাকা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব সার্বিক পর্যটন উন্নয়নকে শুধু বাধাগ্রস্তই করেনি উপরন্তু পর্যটন পণ্যের প্রতিযোগীতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের অবস্থানকে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে।

তাই আমাদের অতি সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে যথাযথভাবে উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু সাহসী ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে – প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস; উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন; পরিকল্পনা বাস্তবায়ন; অর্থায়ন; আইন প্রণয়ন; পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণন এবং অন্যান্য।

০১।  প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস

পর্যটন উন্নয়নের জন্য আমাদের মত সম্ভাবনাময় ও জনবহুল দেশের ক্ষেত্রে পৃথক ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কোন বিকল্প নেই। আর তাই এই দাবী বহু দিনের এবং যৌক্তিক বিধায় যতটুকু জানা যায় সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এখন সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে কাজটি সহজেই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের জন্য জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য ভৌগলিক, পারিপার্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পৃথিবীর একেক দেশের পর্যটন কাঠামো একেক রকমের হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশের পর্যটন কাঠামোতে রয়েছে মন্ত্রণালয়, পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সহযোগী হিসেবে আঞ্চলিক পর্যটন কার্যালয়। অবশ্য এজন্য আমাদের খুব একটা কিছু করতে হবেনা শুধু বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে কর্মপরিধি ঠিক করে নিলেই চলবে। যেখানে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবে প্রকল্প অনুমোদন, বাজেট প্রস্তুতকরণ, সার্বিক সমন্বয় সাধন ও আইন প্রণয়ন।

অন্যদিকে মাঠ প্রশাসন হিসেবে পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে থাকবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; পণ্য ও সেবার মান উন্নয়ন; পণ্য নির্বাচন ও বাজার অনুসন্ধান, প্রচার ও বিপণন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ। সাথে সহযোগী হিসেবে এবং পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে থেকে “আঞ্চলিক পর্যটন কার্যালয়” (Regional Tourism Office) সার্বিকভাবে অঞ্চল ভিত্তিক পর্যটন কর্মকাণ্ড  পরিচালনায় সক্রিয় থাকবে। যেহেতু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক ও মানর সৃষ্ট উভয় প্রকারের পর্যটক আকর্ষণ রয়েছে সেহেতু এগুলোর প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং তাদের পরিদর্শন উপযোগী করার জন্য –  (ক) সরকার তথা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন উদ্যোগে সহায়তা দেয়া;  (খ) তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহে ভূমিকা রাখা;  (গ) পর্যটকদের মান সম্পন্ন সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও ভালো-মন্দ দেখভাল করা;  (ঘ) স্থানীয়ভাবে পর্যটন দায়কগোষ্ঠী বা ষ্টেকহোল্ডার ও দায়িত্বশীল পর্যটন চর্চার সাথে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর সমন্বয় করা এবং (ঙ) স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও সংস্কৃতি বিকাশে সরকারের প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি কর্ম সম্পাদন করা। এমতাবস্থায় আমাদের পর্যটন শিল্প উপযোগী একটি প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস করার জন্য যা যা করা দরকার তা হলোঃ

১ : ১ –  স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয় গঠন করা।

১ : ২ –  “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” এবং “বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড” এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে একত্রিত করে একটি “পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ” (Tourism Development Authority – TDA) গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব অর্পন করে কাজের সমন্বয় দ্বারা গতি, ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

১: ৩ –  ইতোমধ্যে প্রস্তাবকৃত ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত পর্যটন পণ্য ভিত্তিক যে ১০ (দশ) টি “পর্যটন প্রশাসনিক অঞ্চল” গঠন প্রক্রিয়াটি ফাইলবন্দি রয়েছে তা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

১ : ৪ –  কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ বিভিন্ন বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 

০২।  উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন

পর্যটন উন্নয়নে সঠিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। অথচ আজ পর্যন্ত আমরা এমন কোন পরিকল্পনাকে অবলম্বন করে পর্যটন উন্নয়নমূলক কোন কাজ করতে পারিনি। উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে কেবল মহা-পরিকল্পনার চিন্তাই করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এতে করে আমাদের গোটা পর্যটন শিল্পই পরিকল্পনার অভাবে একেবারে এলোমেলোভাবে চলছে। কোন বিষয়ে যখন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন সময়ই বলে দেয় কখন একটি মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরী। মোদ্দাকথা, মহাপরিকল্পনা পরিকল্পনারই রূপান্তর যা ব্যাপক ও বিস্তৃত বলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের হয়ে থাকে। আমাদের পর্যটন শিল্প এত বছর যাবৎ সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই চলার পর এখন মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন যেমনি অত্যাবশ্যকীয় তেমনি সাময়িক কিংবা জরুরী ভিত্তিতে হলেও পর্যটনকে অন্তত একটি পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই।

তার সাথে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে যে পরিকল্পনা সে স্বল্প মেয়াদী হোক আর দীর্ঘ মেয়াদী মহাপরিকল্পনাই হোক এজন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতে হবে এমন কোন কথা নেই। কারণ, এত বছর পর আমাদের দেশে কোন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোক সৃষ্টি হন নি তা কিন্তু নয়। বরং এমন অনেকেই আছেন যারা পর্যটনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাদের বিচরণ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তাই এদেরকে আমরা কাজে লাগাতে পারি এবং প্রয়োজনে তাদেরকে বিদেশ পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ করে দিতে পারি। অবশ্য প্রয়োজন মনে করলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোন পর্যটন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তবে, পরিকল্পনা সে যাই হোক না কেন এজন্য যে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে তা হলোঃ

২ ঃ ১ –  অভিজ্ঞতার আলোকে ভূ-প্রকৃতি, ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে সময়ের দাবী বিবেচনায় নিয়ে বারবার ব্যর্থ হওয়া দীর্ঘ মেয়াদী পর্যটন মহা-পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বাস্তব সম্মত ও যুগোপযোগী তিন অথবা চার বছর মেয়াদী “কৌশগত পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা” (Strategic Tourism Development Plan) প্রণয়ন।

২ ঃ ২ –  বিদ্যমান ও সম্ভাব্য উভয় প্রকারের সকল পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটক গন্তব্য, আকর্ষণ ও সেবা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন পণ্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগীতার বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিকল্পনার উদ্দেশ্য নির্ধারণ।

২ :৩ –  প্রাপ্ত সকল পর্যটন সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায় এবং সকল ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডার (Tourism Stakeholder) বা পর্যটন দায়কগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা যায় এমন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।

২ : ৪ –  বিদ্যমান ও সম্ভাব্য সকল পর্যটন পণ্য চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিপণন নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন কৌশল পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করা।

২ : ৫ –  শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সাধারণ ও পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম এমন পর্যটন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।

২ :৬ –  সার্বিক পর্যটন উন্নয়ন, পর্যটন সেবার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, পর্যটন সেবা প্রদানকারীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা বা পর্যটকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম এমন বিষয়গুলোকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২: ৭ –  অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং প্রাপ্তি আরো সহজ করার কৌশল নির্ধারন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করা।

২ : ৮ –  সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে নিয়মিত ও উচ্চ মানসম্পন্ন গবেষণার কোন বিকল্প নেই বিধায় উচ্চতর গবেষণা কাজ চালানো এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন অন্তর্ভূক্ত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২ : ৯ –  আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাথে মানানসই পর্যটন শিক্ষা এবং মান সম্পন্ন প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে মানব সম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২ : ১০ –  পর্যটন শিল্প অন্য সকল শিল্প থেকে আলাদা এবং অত্যন্ত গতিশীল বিধায ট্রায়াল এন্ড এরার মেথড (Trial & Error Method) পদ্ধতি চর্চা করা হয়ে থাকে। তাই, একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে পর্যবেক্ষণকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যাতে পরিকল্পনাটির যথার্থতা নিরূপন করা সম্ভব হয়।

০৩।  উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন  

যে কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নই একমাত্র সমাধান নয়। কেন না প্রণীত পরিকল্পনা যদি যথা সময়ে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা না যায় তাহলে সবকিছুই বিফলে যায়। অথচ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য একটি প্রধান সমস্যা। কেন না শুধু অর্থনৈতিকই নয় রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি প্রাকৃতিক তথা অপ্রত্যাশিত নানা সমস্যা বাস্তবায়নাধীন কর্মকাণ্ডকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ব্যহত করে। তবে, এসব সমস্যার কোন সমাধান নেই তাও নয়। কেন না অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এজন্য পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত সরকারি-বেসরকারি এবং সর্বস্তরের সকলের ঐকান্তিকতা ও সহযোগীতা একান্ত আবশ্যক। অবশ্য এজন্য সরকার তথা সরকারি খাতকেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই পরিকল্পনামাফিক পর্যটন উন্নয়ন কাজ যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য যা যা করা দরকার তার মধ্যে রয়েছেঃ

৩ : ১ –  উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত কর্মকাগুগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এবং সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অগ্রাধিকার নিরূপন করা।

৩ : ২ –  পরিকল্পনাধীন এবং অগ্রাধিকার প্রাপ্ত সকল বিদ্যমান ও চালু কর্মসূচী সচল রাখা কিংবা মেয়াদ মধ্যে সমাপ্ত করার স্বার্থে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা।

৩ : ৩ – বিদ্যমান পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোর গুণগত মান, সাময়িক কিংবা অপ্রত্যাশিত কোন সমস্যা, দীর্ঘসূত্রীতার আশঙ্কা ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা।

৩ : ৪ –  পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত সকল পক্ষ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি ইত্যাদির ভূমিকাকে সক্রিয় রাখার জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং সেল গঠন করা।

৩ : ৫ – সকল প্রকার কালক্ষেপণ, অপচয় এবং দুর্নীতি যা এই মন্ত্রণায়ের জন্য এক অশনীসংকেত তা যেকোন উপায়ে রোধ করা এবং পর্যটনের সুনাম অক্ষুন্ন রাখা।

০৪।  অর্থায়ন  

যে কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তথা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এবং সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। অথচ নানা কারণে আমরা আমাদের পর্যটন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান এমনকি ব্যবহারও নিশ্চিত করতে সমর্থ হইনি। এজন্য যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব, খাতওয়ারী অর্থের চাহিদা নিরূপনে ব্যর্থতা, ফি বছর জাতীয় বাজেটের জন্য প্রস্তাবপত্র তৈরী করতে না পারা এবং বরাদ্দকৃত অর্থ খরচে অমার্জনীয় ব্যর্থতাই মূলত প্রধান সমস্যা হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্প উন্নয়নের গুরুত্ব এবং এই শিল্পের অন্তর্ভূক্ত খাতগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য আয় সম্পর্কে সরকারকে নিয়মিত অবহিত করতে না পারাটাও যোগ হয়েছে এর সাথে।

তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সংশ্লিষ্ট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার জন্য সরকারের সাথে রীতিমত দেনদরবার ও চাপ সৃষ্টি করতে হয়। আর এ কাজটি অনেক সময় রাজনৈতিক সরকার কিংবা প্রশাসনিক সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়না বিধায় বেসরকারি খাতকে ব্যবহার করা জরুরী হয়ে পড়ে। অথচ সে কাজটিও আজ পর্যন্ত আমরা করতে পারিনি বিধায় প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ থেকে একেবারেই বঞ্চিত থাকছি। তাই এই অকালকুষ্মাণ্ডতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিবিগ্ন করার লক্ষে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৪ : ১ – যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে পর্যটনের জন্য এর অগ্রগণ্যতার যথার্থতা যাচাই করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন মেয়াদের কর্মকাণ্ডগুলো নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করা।

৪ : ২ –  উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত খাতগুলোর মধ্য থেকে স্বল্পমেয়াদভূক্ত কিংবা চলমান যেসব কর্মকাণ্ড/খাত/প্রকল্প ইত্যাদি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে ফি বছর এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা নিরূপণ করা।

৪ : ৩ –  বাজেট বরাদ্দ অথবা থোক বরাদ্দ যেভাবেই হোক না কেন বিদ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  এবং বিপণন ও প্রচার বাধাহীনভাবে চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৪ : ৪ –  বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ কিংবা অন্য যে কোন খাত বা মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত অর্থ খাতওয়ারী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এবং যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

০৫।  আইন প্রণয়ন

আইন প্রণয়ন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন রাষ্ট্রেরই কাজ যা গদিনসীন সরকারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। তবে, একাজে সফলতার মুখ দেখতে হলে শৃঙ্খলা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা একান্ত অপরিহার্য। যা কিনা কেবলমাত্র যুতসই, বাস্তবসম্মত ও আধুনিক আইন প্রণয়ন এবং তা যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তাই সময়ে সময়ে এবং প্রয়োজনকে সামনে রেখে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সহায়ক আইন প্রণনের জন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৫ : ১ –  সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প এবং এই শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র সমুহ চিহ্নিত করা এবং বিদ্যমান আইন সমুহের কার্যকরীতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা।

৫ : ২ – প্রয়োজনীয় ও নতুন আইনের খসড়া তৈরী এবং বিদ্যমান ও পরিবর্তনযোগ্য আইনের বিধান সমুহের  প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন চুড়ান্ত করার জন্য একটি সেল গঠন করা।

৫ : ৩ – পর্যটন উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে এমন সমস্যাগুলো দূর করা; পর্যটন আকর্ষণ ও গন্তব্য তথা এলাকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা;  পর্যটন সেবা সরবরাহকারীদের জন্য নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ;   সেবার গুণগত মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ;  ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ; নিরাপদ ভ্রমণ;  মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন এবং বিধি-বিধান ও আচরণ-বিধি প্রণয়নে যে ঘাটতি রয়েছে তা চিহ্নিত করা এবং পূরণ করা।

৫ : ৪ –  নতুনভাবে প্রণীত ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এসব আইনের পক্ষে জনসচেতনতা ও জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

০৬।  পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণন 

প্রচারেই প্রসার। প্রচার ছাড়া কোন শিল্প কিংবা ব্যবসা শুধু যে অগ্রসর হতে পারেনা তা নয় এমন কি টিকে থাকতেও পারেনা। যেজন্য তথ্য প্রযুত্তির এই যুগে পর্যটন ব্যবসা একেবারেই প্রচার নির্ভর হয়ে পড়েছে। তার কারণ, অন্য শিল্পের ক্ষেত্রে পণ্য ভোক্তার কাছে সরাসরি নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে তা মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে ভোক্তাকেই পণ্যের কাছে নিয়ে আসতে হয়। তাই এই শিল্পের প্রচার-প্রচারণা এবং বিপণন ও বিক্রয় প্রক্রিয়া অন্যান্য শিল্প থেকে আলাদা। এতেকরে পর্যটন পণ্যের উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিপণন ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনাকে এমনভাবে সাজানো হয় যে, ভোক্তা আর বাজারই মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে প্রাধান্য পায় নিজেদের পর্যটন পণ্য উপযোগী ভোক্তা তথা পর্যটক এবং লক্ষ্যবস্তু করা হয় পর্যটক যোগানদার সংশ্লিষ্ট দেশ বা দেশসমূহকে। তারপর চালানো হয় প্রচার-প্রচারণার নানাবিধ কার্যক্রম যা পরিকল্পিত বিপণনেরই একটি ধাপ। অথচ আমরা আমাদের পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণনের ক্ষেত্রে তা ঐভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। তাই আমাদের পর্যটন পণ্যের বৈশিষ্ট, প্রকৃতি, গুণাগুণ বা মান এবং নিজস্বতা বিবেচনায় নিয়েই কেবল কার্যকর ও ফলপ্রসু হয় এমন প্রচার-প্রচারণা আর বিপণন-বিক্রয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৬ ঃ ১ – স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, জনপ্রতিনিধি এবং সংবাদকর্মীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে পর্যটন পণ্য (পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্য ও কর্মকাণ্ড; পর্যটকরা যেসব সেবা গ্রহণ করেন এবং তাদের সন্তুষ্টি) চিহ্নিত করার কাজ সম্পন্ন করা এবং এসব পণ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং এর দায়িত্ব প্রদান করা।

৬ : ২ –  বিশ্বের প্রতিটি পর্যটক আকর্ষণকারী দেশই তার এক অথবা একাধিক পর্যটক আকর্ষণকে প্রধাণ হিসেবে চিহ্নিত করে তা পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমরা তা আজো করতে পারিনি বিধায় আমাদের এক অথবা একাধিক পর্যটক আকর্ষণকে প্রধাণ পর্যটক আকর্ষণ (Prime Tourist Attraction) হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। বাদবাকী পর্যটক আকর্ষণগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন বাজার তথা ভোক্তা বা পযটকদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে শ্রেণীকরণ (Classification)করে রাখতে হবে।

৬ : ৩ –  পর্যটন সেবার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ একটি চলমান প্রক্রিয়া যা পর্যটক বা ভোক্তার চাহিদা ও পরিবর্তিত সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া চাই। তাই আজকালকার দুনিয়ায় একাজটির জন্য বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস (Quality Tourism Service) বা কিউটিএস (QTS) অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি পদ্ধতি। এটি চালু করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো বটে। কিন্তু নানা কারণে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি বিধায় এটি অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬ : ৪ –  পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  অনেকটা নাজুক ও পরনির্ভর প্রকৃতির বিধায় বিভিন্ন বিষয়ে শুধু পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কমিটি গঠনই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া, এসব বিষয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কোনভাবেই সুখকর নয়। তাই, যে কোন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ ও কমিটি গঠনের সাথে সাথে কর্মপরিধি ও সময়সীমা বেধে দেয়া একান্ত অপরিহার্য। আর তাই এসব বিষয়ে কোন ছাড় না দিয়ে যথা সময়ে ও নির্বিঘ্নে  লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং সেল গঠন করে দায়িত্ব অর্পন করা।

৬ : ৫ –   পর্যটন শিল্পে সরকারি এবং বেসরকারি খাত একে অপরের পরিপূরক। এর মধ্যে বেসরকারি খাত যেহেতু প্রকৃত অর্থে পর্যটন পণ্য বিক্রী এবং সেবা প্রদানের সাথে সম্পৃক্ত সেহেতু মাঠের মানুষ হিসেবে তাদেরকেই পণ্য ও সেবার মূল বিক্রয়কারী বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাই পর্যটন পণ্যের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও বিপণনের সাথে বেসরকারী খাতের প্রতিটি সেবা বিভাগ যাদের ট্রেড অর্গানাইজেশন (Trade Organization) বা টিও লাইসেন্স রয়েছে তাদের সবাইকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া।

৬ : ৬ –  সামগ্রিকভাবে দেশে-বিদেশে পর্যটন শিল্পের প্রচার ও প্রসার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কেন না কোন কোন পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্য কিংবা পণ্য বা সেবা কোন কোন গন্তব্যের পর্যটকদের জন্য উপযোগী;  কোন কোন প্রচার মাধ্যম বা কি কি প্রচার সামগ্রী কিভাবে কতটুকু ব্যবহার করা হবে;  কোন কোন পর্যটন মেলায় কি কি প্রচার সামগ্রী নিয়ে কারা কারা অংশগ্রহণ করবেন;  কি কি প্রচার-কৌশল কিভাবে কোথায় কতটুকু ব্যবহার করা হবে;  কি কি বাজার ব্যবস্থাপনা কখন কিভাবে কোথায় কাজে লাগানো হবে ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন আসলেই অনেকটা জটিল ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত কাজ। তাই এজন্য সকল পর্যটন দায়কগোষ্ঠী বা ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডার (Tourism Stakeholder) সমন্বয়ে শুধুমাত্র অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি শক্তিশালী ষ্টিয়ারিং (Steering Committee) বা পরিচালন কমিটি গঠন করে দায়িত্ব অর্পন করা।

৬ : ৭ – আমাদের পর্যটন পণ্যের উপর ভিত্তি করে যেসব দেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসার জন্য তালিকাভূক্ত করা হবে সেসব দেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে পর্যটন প্রচারের জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যায়। প্রয়োজনে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে কিছু দূতাবাসের তাদের নিজস্ব কোন বিশেষ কর্মকর্তাকে পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্থায়ীভাবে অথবা পর্যটন মন্ত্রণায়ের প্রতিনিধি হিসেবে পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিকে স্থায়ীভাবে দায়িত্বে রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রকৃত পর্যটকদের জন্য তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি ভিসা সহজীকরণের লক্ষে এয়ারপোর্ট এন্ট্রি ভিসা ও ই-ভিসার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা করা।

৬ : ৮ –  বলা হয়ে থাকে প্রথম অনুভূতিই শেষ অনুভূতি (First impression is the last impression)। তাই, বিদেশী পর্যটকদের বাংলাদেশে প্রবেশের প্রথম অভিজ্ঞতাকে আরো স্মৃতিময়, স্বার্থক-সুন্দর ও তথ্য সমৃদ্ব করার জন্য পর্যটকদের প্রধাণ প্রবেশ পথ যেমন বিমানবন্দর কিংবা স্থলবন্দরে সার্বক্ষণিক, তথ্য সমৃদ্ধ ও কার্যকর অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রবেশ পথে দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিবাসন কর্মকর্তাদের পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

০৭। অন্যান্য 

একটি বিশাল, বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে পর্যটনের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত যেমনি রয়েছে বিভিন্ন খাত, উপখাত, বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তেমনি রয়েছেন স্বার্থসংশ্লিষ্ট অংশীজন এবং নানাবিদ কর্মকাণ্ড  ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যা যথাযথভাবে সমন্বয় করে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করা না গেলে উন্নয়ন কাজ ব্যহত হয়। এমনকি অনেক সময় কালক্ষেপণের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মাঠে মারা যায়। এর মধ্যে বেশকিছু বিষয় রয়েছে যা এড়িয়ে যাবার তেমন কোন সুযোগ নেই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

৭ : ১ –  পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু বছর আগে অথচ শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি আজো। এমন কি পরবর্তীতে থ্রাষ্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরও বিষয়টি গুরুত্ব পায় নি। অথচ সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন চাইলে শিল্প সহায়ক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা দরকার। তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এই শিল্পের সার্বিক ও স্বাভাবিক উন্নয়নের স্বার্থে চিহ্নিত শিল্প সহায়ক সুবিধাগুলো যেমন – জমি বরাদ্দ (সত্যিকার সৎ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের মধ্যে);  বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ (অগ্রাধিকার ভিত্তিতে); আর্থিক সহায়তা (সহজ শর্তে ঋণ, স্বল্প সুদে ঋণ, প্রনোদনা);  কর অবকাশ (মাঝারি ও ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে);  কর রেয়াত (পর্যটন অবকাঠামো যেমন আবাসন, খাবার ও পানীয়, পর্যটন যান, বিনোদন ও ক্রীড়া সামগ্রী ইত্যাদি আমদানীর ক্ষেত্রে);  মুসক রেয়াত (ভ্রমণ, আবাসন, খাবার ও পানীয় ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে);  সুরা সরবরাহের অনুমতি (শুধুমাত্র কিউটিএস তালিকাভুক্ত ও বিদেশি পর্যটক সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য) এবং নিরাপত্তা ও শিল্পের পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

৭ : ২ –  মনে রাখতে হবে শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়ে গেলেই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে তা নয়। এজন্য যা করতে হবে তা হলো পর্যটন অবকাঠামো যেমন আবাসন, পর্যটন যান, খাবার ও পানীয়, বিনোদন এবং পর্যটক পল্লী (Tourist Village) ও নিবিড় পর্যটক এলাকা বা বেষ্টনী (Exclusive Tourist Zone) ইত্যাদিতে দেশি-বিদেশি এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (Direct Foreign Investment) বৃদ্ধিকে সামনে রেখে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা ওএসএস (OSS) চালু করার পাশাপাশি পর্যটন বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৭ :৩ -বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে উন্নতমানের পর্যটন শিক্ষা এখন বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশেও ইদানীংকালে উচ্চ পর্যায়ে পর্যটন শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে যদিও এগুলোর গুণগত মান দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পর্যটন শিক্ষারও কোন সুযোগ নেই। তাই সর্বোস্তরে পর্যটন শিক্ষা চালু করণ, পাঠ্যসূচী প্রণয়ন/অনুমোদন, পর্যটন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যটন বিষয়ে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি “জাতীয় পর্যটন শিক্ষা কাউন্সিল” (National Tourism Education Council) গঠন করা।

৭ : ৪ –  পর্যটন যেহেতু শতভাগ সেবা নির্ভর একটি শিল্প সেহেতু এর প্রতিটি সেবা খাত মাঠ উপযোগী ও প্রয়োজন ভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নির্ভর হওয়ায় মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অথচ বাংলাদেশে মানসম্পন্ন পর্যটন প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এটা মানতেই হয়। তাই, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পরিচালিত পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান “এনএইসটিটিআই”-কে আগেকার নামে অর্থাৎ “ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট” বা টিটিআই নামে অথবা “জাতীয় পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান” বা ন্যাশনাল ট্যুরিজম ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (National Tourism Training Institute)) নামে একটি আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা এবং সময়ের দাবী পূরণ করা।

৭ : ৫ – পর্যটন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, চাকুরীদাতা এদের সমন্বয় এবং তাদের মধ্যেকার পারষ্পরিক সম্পর্ক ও স্বার্থ দেখভালের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেল বা কমিশন (Cell/Commission) থাকা খুবই জরুরী। যাতে জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো স্তর অনুযায়ী জাতীয় সনদায়ন,  সকল স্তরে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণ,  চাকুরীর ব্যবস্থা গ্রহণ,  পর্যটন কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে পক্ষগুলোর মধ্যেকার পারষ্পরিক সম্পর্ক সমন্বয় করা সম্ভব হয়। যার উদ্দেশ্য থাকবে নিজ দেশের পর্যটন কর্মীদের চাকুরীর ব্যবস্থা করা এবং বিদেশিরা এসে চাকুরীর মাধ্যমে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া রোধ করা।

৭ : ৬ –   পর্যটন শিল্পের মত একটি শ্রেষ্ট শিল্প তথা ব্যবসা কোন অবস্থাতেই হিসাব ছাড়া চলতে পারেনা। অথচ মানতে হবে যে আমরা তাই নিয়ে চলছি। এজন্য পর্যটক আগমন-নির্গমন,  আয়-ব্যয়,  লোকবল ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান তথা হিসাব সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিসহ জিডিপি (GDP)-তে পর্যটনের অবদান নিরূপনের জন্য অনতিবিলম্বে অবহেলায় ফেলে রাখা “ট্যুরিজম স্যাটেলাইট একাউন্ট” (Tourism Sattelite Account) বা টিএসএ (TSA) পদ্ধতিটির ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৭ : ৭ –  পর্যটন একটি শ্রমঘন ও বহুমাত্রিক শিল্প যার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এমন এক শিল্পের সর্বশেষ ও নির্ভরযোগ্য যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত জানা না থাকলে এই শিল্পের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড,  শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ,  গবেষণা,  প্রচার-প্রচারণা এবং পর্যটকদের তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর কাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, এমনিতেই তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যা আইন দ্বারা নিশ্চিত করা আছে। অথচ এমনই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় পর্যটনে শুধু অনুপস্থিতই নয় উপরন্তু আমরা নিশ্চুপ ও নির্বাক যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। তাই,  বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অনতিবিলম্বে “জাতীয় পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার” (National Tourism Data Base) প্রতিষ্ঠা করা।

৭ : ৮ –   বলা হয়ে থাকে যে দেশ গবেষণায় যত উন্নত সে দেশও তত উন্নত। তাই দেখা যায় যে দেশে শিল্প-বাণিজ্য উন্নত সে দেশে গবেষণার বিষয়টিও উন্নত। এই বিবেচনায় পর্যটনের মত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পটির জন্য গবেষণা কর্ম কত গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়। অথচ আমাদের এত সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের জন্য আজ পর্যন্ত গবেষণা কাজ চালানোর কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। তাই কালবিলম্ব না করে প্রথমে একটি “পর্যটন গবেষণা সেল” (Tourism Research Cell) গঠন করে কার্যক্রম শুরু করা এবং পর্যায়ক্রমে তা “জাতীয় পর্যটন গবেষণা ইন্সটিটিউট” (National Tourism Research Institute)-এ রূপান্তর করা।

৭ : ৯ –   আমাদের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে দেশি-বিদেশি ব্যক্তি,  প্রতিষ্ঠান,  দাতা সংস্থা,  এনজিও ইত্যাদি তাদের সাহায্য ও সহযোগীতার হাত প্রসারিত করতে পারেন এবং কেউ কেউ করছেনও। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য,  পরিকল্পনা ও কার্যক্রম ইত্যাদি বিস্তারিত জানা না থাকলে পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করা যেমনি সম্ভব হয়না তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, বিশৃঙ্খলা এমনকি ভুল বোঝাবোঝিরও সৃষ্টি হয়। তাই এসব সাহায্যকারী কিংবা সহায়তাদানকারী যারাই বাংলাদেশের ভিতর বিভিন্ন ধরণের পর্যটন কার্যক্রম চালাচ্ছেন বা চালাতে ইচ্ছুক তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অথবা জানানো বাধ্যতামূলক করা।

৭ : ১০ –  ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফ বি সি সি আই (FBCCI) ব্যবসায়ীদের নের্তৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় এবং শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের সাথে আইনানুগ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশে-বিদেশে কাজ করে থাকে। তার সাথে ট্রেড অর্গানাইজেশন বা টি ও (TO) লাইসেন্সপ্রাপ্ত পর্যটন সমিতিগুলোও নিবিঢ়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে বিধায় এফ বি সি সি আইসহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর,  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,  বিনিয়োগ বোর্ড,  বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ,  রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো এর মত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজন মোতাবেক পর্যটন উন্নয়ন সহযোগী করার পাশাপাশি বিশেষ করে বিনিয়োগ, শিল্প সহায়ক সুবিধা এবং প্রচার ও বিপণনে অংশীদার হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭ : ১১ – পর্যটন একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত তথা বহুমাত্রিক এবং শতভাগ সেবা নির্ভর শিল্প হওয়ায় এর সাথে অনেকগুলো সেবা ভিত্তিক ব্যবসা যেমন যানবাহন,  আবাসন,  খাবার ও পানীয়,  বিনোদন,  ট্র্যভেল ও ট্যুরস ইত্যাদি সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে। তাদের সাথের আইনি সম্পর্ককে শুধু নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সত্যিকার দায়কগোষ্ঠী সম্পর্ক বা স্টেকহোল্ডার রিলেশন (Stakeholder Relation) গড়ে তুলে একদিকে যার যার সেবার প্রকৃতি ভেদে তাদের ব্যবসায় বিরাজিত সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সাথে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আবার অন্যদিকে প্রতিটি সমিতিকে সমানভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে পর্যটন উন্নয়নের সত্যিকার অংশীদার হিসেবে তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে কাজে লাগানো।

৭ : ১২ – বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও কিছু ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত থেকে এবং দেশে-বিদেশে কাজ করে সার্বিকভাবে পর্যটন বিষয়ে প্রচুর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি সরাসরি অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অবসরে চলেগেছেন বা চলে যাবেন। এমনসব বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মানুষদের তাদের লব্দ অভিজ্ঞতা আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটনের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েকজনকে বাছাই করে সার্বিক পর্যটন শিল্পে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করে “ট্যুরিজম এলিট প্যানেল” (Tourism Elite Panel – TEP) এর মত একটি প্যানেলভুক্ত করে রাখা। যাতে নীতি নির্ধারণ কিংবা পর্যটনের যেকোন বিষয়ে এবং যে কোন সময়ে তাদের মতামত বা পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, পর্যটন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও বহুমাত্রিক শিল্প। এর একদিকে রয়েছে বিভিন্ন খাত-উপখাত, সেবা প্রদানকারী,  সেবা গ্রহণকারী,  উন্নয়ন সহযোগী ও অন্যান্য অংশীদার এবং অন্যদিকে রয়েছে পর্যটন আকর্ষণ ও গন্তব্য এবং পর্যটন সেবা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এই যে এক মহাসম্মিলনী তার ভালোমন্দ সবকিছু এই ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে আনা কঠিন। কেন না এটি শতভাগ সেবা নির্ভর এবং দ্রুত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনশীল এক শিল্প মাধ্যম যাকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় এবং চাহিদা পূরণ করতে হয়। এর মধ্যেই আমাদেরকে এই শিল্পের বিকাশের স্বার্থে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। অতএব টেকসই পর্যটন উন্নয়নকে সামনে রেখে অন্তত এই কাজগুলো করা গেলে বাকীটা সময়ই বলে দেবে কখন কিভাবে কি করতে হবে। তাতেই আমরা আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটনকে উন্নয়নের সড়ক এমন কি মহাসড়কেও নিয়ে যেতে পারবো।

লেখকঃ চেয়ারম্যান,  সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)

ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নের রূপরেখা

আপডেট সময় ০৭:৪৭:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৫

জামিউল আহমেদ : সাধারণ অর্থে ভ্রমণ বিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড কে বলা হয় পর্যটন। তাই পর্যটনের পরিধি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। পর্যটনকে অনেকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

 

পর্যটন কি

সাধারণ অর্থে ভ্রমণ বিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড কে বলা হয় পর্যটন। তাই পর্যটনের পরিধি ব্যাপক এবং বিস্তৃত। পর্যটনকে অনেকে অনেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মধ্যে “জাতিসংঘ বিশ্ব  পর্যটন সংস্থা” বা ইউ এন ডাবলু টি ও (UNWTO)-এর দেয়া সংজ্ঞাটি এখন বিশ্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং সর্বক্ষেত্রে ব্যবহারও করা হচ্ছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী পর্যটন হচ্ছে, “মানুষের এমন সব কর্মকাণ্ড যা তাদের স্বাভাবিক বসবাসের স্থান থেকে অন্য কোন নতুন স্থানে অবসর বিনোদন,  ছুটি কাটানো, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, ধর্ম ইত্যাদি কারণে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া ব্যতিরেকে কমপক্ষে একদিন কিন্তু তিনশত পয়ষট্টি দিনের কম সময়ের জন্য ভ্রমণের সাথে সম্পৃক্ত”। সজ্ঞাটিতে বর্ণিত ভ্রমণ সম্পৃক্ত এসব কর্মকাণ্ড  যেগুলোকে আমরা ব্যাপক অর্থে কর্মযজ্ঞ বলতে পারি তাই হচ্ছে পর্যটন তথা এই শিল্পের অন্তর্নিহিত শক্তি। তাই এসব কর্মকাণ্ড  একদিকে মানুষের বিষয়ভিত্তিক ভ্রমণকে করে আরো নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও শিক্ষামূলক এবং অন্যদিকে পর্যটন থেকে আয়ের পথকে করে আরো সুগম ও সমৃদ্ধ।

পর্যটন কেন

মানুষ যখন থেকে ভ্রমনে বেরিয়েছে তখন থেকেই ভ্রমণ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। তবে, বিশেষ করে পর্যটন যখন থেকে মানুষের ভ্রমণকে আরো গোছালোভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে তখন থেকেই তা একটি আকর্ষণীয় ব্যবসার মাধ্যম হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। পরবর্তীতে এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পর্যটন গোটা বিশ্বে নানাভাবে মানুষের জীবন ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে অবদান রেখে চলেছে। তাহলে পর্যটনের এসব অবদান কি মানুষ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছে?  অবশ্যই পারছে এবং পর্যটন থেকে এসব প্রাপ্তির মধ্যে যা যা উল্লেখযোগ্য তার মধ্যে রয়েছে –

  • ভ্রমণকে আরো বেশি কার্যকর, উপভোগ্য, ঝুঁকিমুক্ত, সাশ্রয়ী ও বহুমাত্রিক করা।
  • গন্তব্য, আকর্ষণ, দর্শণীয় স্থান, ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি আরো ভালোভাবে দেখা, জানা এবং তা থেকে শেখার সুযোগ পাওয়া।
  • শিক্ষার বাহন তথা হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো।
  • পর্যটকদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে বেশি বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি।
  • বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি।
  • মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি।
  • টেকসই পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সার্বিকভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা।
  • পরিকল্পিতভাবে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির যথাযথ সংরক্ষণ এবং লালন নিশ্চিত করা।
  • ধর্মীয় কর্মকাণ্ড  যেমন তীর্থযাত্রা, ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
  • সামাজিক বন্ধন, আঞ্চলিক সহযোগীতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা।

এছাড়াও উল্লেখ করার মত পর্যটনের আরো অনেক অবদান রয়েছে। তারপরও যা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকেই বুঝা যায় পর্যটন কেন এবং বর্তমানে এর অবস্থান কোথায়। পর্যটনকে ব্যবহার করে আজ অনেক জাতি এবং দেশ উন্নয়নের মুখ দেখতে পেরেছে। আবার অনেক দেশের প্রধাণ আয়ের উৎস হচ্ছে এই পর্যটন। এমন কি অনেক স্বল্পোন্নত দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধাণ কয়েকটি উৎসের মধ্যে রয়েছে এই পর্যটন। এজন্য আজকাল দুনিয়া জুড়ে পর্যটনের জয়জয়কার। আর তাই জাতিসঙ্ঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা বা ইউ এন ডাবলু টি ও (UNWTO) বলেছে, “পর্যটন ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং গোটা বিশ্বের সমৃদ্ধি আনে”।

বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা 

বাংলাদেশ তার ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, মাটি ও মানুষ এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বে গর্ব করতে পারে এমন বিরল দেশগুলোর একটি। কেন না প্রকৃতি দেশটিকে অপার দিয়েছে যা শুধু দেখলেই কেবল বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে। সমতল ভূমি থেকে শুরু করে টিলা-পাহাড়, বন-বনাঞ্চল, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, সমুদ্র এবং দ্বীপ কি নাই এই দেশটিতে। তার সাথে যোগ হয়েছে সহজ-সরল গ্রামীণ সমাজ ভিত্তিক হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর শহুরে জীবন ব্যবস্থা। তাই এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে টানার জন্য রয়েছে যথেষ্ট উপকরণ। অবশ্য মানবসৃষ্ট তেমন একটা না হলেও অন্তত প্রকৃতি প্রদত্ত পর্যটক আকর্ষণ বহুকাল থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটক গন্তব্য হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। তারপর কালের বিবর্তনে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন আরো অনেক পর্যটক আকর্ষণ। এগুলো যথাযথ উন্নয়নের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন পর্যটন পণ্য। যার উপকরণ তথা যোগানদার হিসেবে কাজ করেছে আমাদের সাগর, সৈকত, দ্বীপ, নদী, বিল, জলাশয়, হাওর, লেক, পাহাড়, বনাঞ্চল, গ্রাম-বাংলা, প্রত্ন সম্পদ, স্থাপত্যশৈলী, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, আদিবাসী, ধর্ম, ক্রীড়া, বিনোদন এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি।

এসব উপকরণ বা পর্যটন সম্পদ ব্যবহার করে আধুনিক ও প্রতিযোগীতামূলক পর্যটন বাজার উপযোগী নতুন নতুন পর্যটন পণ্য সৃষ্টি তেমন কোন ব্যাপারই নয়। কারণ, আজকাল পর্যটন পণ্যকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পর্যটকদের যাই আকৃষ্ট করানো যায় তাই কোন না কোন পর্যটন পণ্য হিসেবে পর্যটন বাজার দখল করে বসে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইদানীংকালে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে হালাল ট্যুরিজমকে অনেকটাই শীর্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব বিবেচনায় আমাদের যেসব পর্যটন উপকরণ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা প্রচুর। কেন না শুধু ইচ্ছাশক্তি এবং আন্তরিকতা থাকলে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার পর্যটন সম্পদের সাথে পর্যাপ্ত ও সহজলভ্য মানব সম্পদ থাকায় এসব পর্যটন উপকরণ পর্যটন পণ্যে রূপান্তর করে পর্যটন উন্নয়নকে তরান্বিত করা কোন ব্যাপারই নয়।

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নে অন্তরায়

প্রযুক্তির বদৌলতে আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থাপনা এগিয়ে যাচ্ছে অনেকটাই দুর্বার গতিতে। যেজন্য গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটন পণ্য আর বেগবান হচ্ছে প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থা। তাই এখন সেই সনাতনী বা প্রচলিত এবং নামিদামী পর্যটক গন্তব্যগুলো মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে যদি সে তার পর্যটন পণ্য সম্পর্কে পর্যটকদের ধারণা দিতে এবং আকৃষ্ট করতে না পারে। অর্থাৎ পর্যটকদের কাছে এখন কোন বিশেষ গন্তব্যই শুধু আকর্ষণের বিষয় নয় যদি না ঐ আকর্ষণের ধরণ এবং সেবার গুণগত মান তাকে আকৃষ্ট করে। কেন না পর্যটকরা এখন এটা খুব ভালো করেই জানে যে বাড়ি ফেরার সময় আর কিছুই নয় বরং শুধু ঐ সন্তুষ্টিটুকুই থাকে তার সাথে। তাই আজকাল পর্যটকরা খুবই সচেতন বিধায় পর্যটন পণ্যের ব্যাপারে তারা কোন ছাড় দিতে একেবারেই নারাজ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের পর্যটন পণ্যগুলো একেবারেই সেকেলে এবং প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থার অনুপযোগী।

কেন না পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটক আকর্ষণগুলো চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ এবং মান উপযোগী করে উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার তা নানা কারণে আমরা করতে পারছি না। তার সাথে পর্যটক সেবা এবং সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করাতো যাচ্ছেইনা উপরন্তু দিন দিন নানা সমস্যা জঞ্জালের মত শুধু স্তুপাকার হচ্ছে আর আমরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছেঃ  স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয় না থাকা; যথাযথ পর্যটন তথা প্রশাসনিক কাঠামোর অনুপস্থিতি; আধুনিক ও বাস্তব সম্মত পর্যটন ব্যবস্থাপনার অভাব; অসুস্থ রাজনীতি; আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা; বেসরকারি খাতের অনৈক্য ও নির্লিপ্ততা; পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়া; যথাযথ পরিকল্পনা না থাকা; বাজেট বরাদ্দ না থাকা; পণ্য চিহ্নিতকরণ না হওয়া; সেবার মান নিয়ন্ত্রণ না করা; শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত না করা; বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না করা; আইন প্রণয়ন না করা; মান সম্পন্ন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করা; সাধারণ অবকাঠামো ও পর্যটন অবকাঠামোর উন্নয়ন না করা; ভাবমূর্তী উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেয়া; সমন্বয় না করা; ব্যাপক ভিত্তিক প্রচার-প্রচারণা ও কার্যকর বিপণন নিশ্চিত না করা; নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা; পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার সৃষ্টি ও তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না করা; সঠিক পরিসংখ্যান না থাকা; পর্যটন গবেষণা কাজের অনুপস্থিতি এবং সর্বোপরি সরকার প্রধান কর্তৃক সার্বিক পর্যটন উন্নয়নে পৃষ্টপোষকতা ও নেতৃত্ব না দেয়ার মত বিষয়গুলো।

বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পর ১৯৭২ সালে “বাংলাদেশ পর্যটন কপপোরেশন” (বাপক) অধ্যাদেশ-এর মধ্য দিয়ে পর্যটন তার যাত্রা শুরু করে। প্রথম দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন যে আঙ্গিকে ও গতিতে তার পথ চলা শুরু করেছিল তা এক সময় ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। একের পর এক সরকার ক্ষমতায় এসে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই অন্য সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোকে পাশ কাটিয়ে স্রেফ নিজেদের পছন্দমত পদক্ষেপ নেয়াতে পর্যটন উন্নয়নে যতটুকুইবা কাজ হয়েছিল তা ধারাবাহিকতা ও সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তবে এটা স্বীকার্য যে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সাধারণ মানুষকে পর্যটনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করা, পর্যটন সেবার সাথে পরিচিত করা, পর্যটনকে একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া, পর্যটন শিল্প উপযোগী মানব সম্পদ তৈরী করা এমন কি পর্যটন শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা ইত্যকার কাজগুলো বেশ সফলতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রশাসনিক জঠিলতার আবর্তে পড়ে এবং সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সে ধারাবাহিকতা ও আবহ খুব একটা বজায় রাখতে সক্ষম হয়নি। কেন না ১৯৯২ সালে পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন এবং পর্যটনকে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করা হলেও তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। এজন্য সবচেয়ে বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়িত না হওয়া এবং শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত না করার মত বিষয়গুলো।

পরবর্তীতে পর্যটন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষে ২০১০ সালে পর্যটন নীতিমালা পুন:প্রণয়ন এবং “বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড” (বিটিবি) গঠনও তেমন একটা সফলতা আনতে পারেনি। কেন না সঠিক পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে পর্যটন নীতিমালা বাস্তবায়ন হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড-কে জনবল, অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবের মধ্যে রেখে পর্যটন উন্নয়ন ও প্রচারের সার্বিক দায়িত্ব দেয়াও তেমন কোন কাজে লাগেনি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন যাবৎ জনবল, সম্পদ, অভিজ্ঞতা, পরিচিতি যে বাংলাদেশ পর্যটন কপপোরেশন-এর কাছে রক্ষিত ছিল তাকে স্রেফ ব্যবসা-বাণিজ্যের আবর্তে ফেলে দেয়াতে পুরো পর্যটন কাঠামোই একটা অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। কেন না গোটা দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত যে ৩০-৩৫ টি দেশে তাদের পর্যটন বোর্ড কাজ করছে সেগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও কর্মপরিধি পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের এই দুর্বল অবস্থান পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। এতে করে একদিকে দুর্বল ও অস্পষ্ট পর্যটন কাঠামো; অন্যদিকে যুগোপযোগী ও টেকসই পরিকল্পনা না থাকা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব সার্বিক পর্যটন উন্নয়নকে শুধু বাধাগ্রস্তই করেনি উপরন্তু পর্যটন পণ্যের প্রতিযোগীতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের অবস্থানকে অনেকটাই দুর্বল করে ফেলেছে।

তাই আমাদের অতি সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে যথাযথভাবে উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু সাহসী ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে – প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস; উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন; পরিকল্পনা বাস্তবায়ন; অর্থায়ন; আইন প্রণয়ন; পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণন এবং অন্যান্য।

০১।  প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস

পর্যটন উন্নয়নের জন্য আমাদের মত সম্ভাবনাময় ও জনবহুল দেশের ক্ষেত্রে পৃথক ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কোন বিকল্প নেই। আর তাই এই দাবী বহু দিনের এবং যৌক্তিক বিধায় যতটুকু জানা যায় সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এখন সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে কাজটি সহজেই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের জন্য জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য ভৌগলিক, পারিপার্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পৃথিবীর একেক দেশের পর্যটন কাঠামো একেক রকমের হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশের পর্যটন কাঠামোতে রয়েছে মন্ত্রণালয়, পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সহযোগী হিসেবে আঞ্চলিক পর্যটন কার্যালয়। অবশ্য এজন্য আমাদের খুব একটা কিছু করতে হবেনা শুধু বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে কর্মপরিধি ঠিক করে নিলেই চলবে। যেখানে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবে প্রকল্প অনুমোদন, বাজেট প্রস্তুতকরণ, সার্বিক সমন্বয় সাধন ও আইন প্রণয়ন।

অন্যদিকে মাঠ প্রশাসন হিসেবে পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে থাকবে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; পণ্য ও সেবার মান উন্নয়ন; পণ্য নির্বাচন ও বাজার অনুসন্ধান, প্রচার ও বিপণন, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ। সাথে সহযোগী হিসেবে এবং পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে থেকে “আঞ্চলিক পর্যটন কার্যালয়” (Regional Tourism Office) সার্বিকভাবে অঞ্চল ভিত্তিক পর্যটন কর্মকাণ্ড  পরিচালনায় সক্রিয় থাকবে। যেহেতু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক ও মানর সৃষ্ট উভয় প্রকারের পর্যটক আকর্ষণ রয়েছে সেহেতু এগুলোর প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা এবং তাদের পরিদর্শন উপযোগী করার জন্য –  (ক) সরকার তথা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন উদ্যোগে সহায়তা দেয়া;  (খ) তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহে ভূমিকা রাখা;  (গ) পর্যটকদের মান সম্পন্ন সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও ভালো-মন্দ দেখভাল করা;  (ঘ) স্থানীয়ভাবে পর্যটন দায়কগোষ্ঠী বা ষ্টেকহোল্ডার ও দায়িত্বশীল পর্যটন চর্চার সাথে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর সমন্বয় করা এবং (ঙ) স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ ও সংস্কৃতি বিকাশে সরকারের প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি কর্ম সম্পাদন করা। এমতাবস্থায় আমাদের পর্যটন শিল্প উপযোগী একটি প্রশাসনিক কাঠামো বিণ্যাস করার জন্য যা যা করা দরকার তা হলোঃ

১ : ১ –  স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী পর্যটন মন্ত্রণালয় গঠন করা।

১ : ২ –  “বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন” এবং “বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড” এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে একত্রিত করে একটি “পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ” (Tourism Development Authority – TDA) গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব অর্পন করে কাজের সমন্বয় দ্বারা গতি, ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

১: ৩ –  ইতোমধ্যে প্রস্তাবকৃত ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত পর্যটন পণ্য ভিত্তিক যে ১০ (দশ) টি “পর্যটন প্রশাসনিক অঞ্চল” গঠন প্রক্রিয়াটি ফাইলবন্দি রয়েছে তা অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

১ : ৪ –  কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ বিভিন্ন বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 

০২।  উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন

পর্যটন উন্নয়নে সঠিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। অথচ আজ পর্যন্ত আমরা এমন কোন পরিকল্পনাকে অবলম্বন করে পর্যটন উন্নয়নমূলক কোন কাজ করতে পারিনি। উপরন্তু বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে কেবল মহা-পরিকল্পনার চিন্তাই করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এতে করে আমাদের গোটা পর্যটন শিল্পই পরিকল্পনার অভাবে একেবারে এলোমেলোভাবে চলছে। কোন বিষয়ে যখন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলতে থাকে তখন সময়ই বলে দেয় কখন একটি মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরী। মোদ্দাকথা, মহাপরিকল্পনা পরিকল্পনারই রূপান্তর যা ব্যাপক ও বিস্তৃত বলে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের হয়ে থাকে। আমাদের পর্যটন শিল্প এত বছর যাবৎ সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই চলার পর এখন মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন যেমনি অত্যাবশ্যকীয় তেমনি সাময়িক কিংবা জরুরী ভিত্তিতে হলেও পর্যটনকে অন্তত একটি পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই।

তার সাথে এ বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে যে পরিকল্পনা সে স্বল্প মেয়াদী হোক আর দীর্ঘ মেয়াদী মহাপরিকল্পনাই হোক এজন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতে হবে এমন কোন কথা নেই। কারণ, এত বছর পর আমাদের দেশে কোন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোক সৃষ্টি হন নি তা কিন্তু নয়। বরং এমন অনেকেই আছেন যারা পর্যটনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাদের বিচরণ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তাই এদেরকে আমরা কাজে লাগাতে পারি এবং প্রয়োজনে তাদেরকে বিদেশ পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ করে দিতে পারি। অবশ্য প্রয়োজন মনে করলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোন পর্যটন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তবে, পরিকল্পনা সে যাই হোক না কেন এজন্য যে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে তা হলোঃ

২ ঃ ১ –  অভিজ্ঞতার আলোকে ভূ-প্রকৃতি, ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে সময়ের দাবী বিবেচনায় নিয়ে বারবার ব্যর্থ হওয়া দীর্ঘ মেয়াদী পর্যটন মহা-পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বাস্তব সম্মত ও যুগোপযোগী তিন অথবা চার বছর মেয়াদী “কৌশগত পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনা” (Strategic Tourism Development Plan) প্রণয়ন।

২ ঃ ২ –  বিদ্যমান ও সম্ভাব্য উভয় প্রকারের সকল পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটক গন্তব্য, আকর্ষণ ও সেবা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন পণ্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগীতার বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিকল্পনার উদ্দেশ্য নির্ধারণ।

২ :৩ –  প্রাপ্ত সকল পর্যটন সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায় এবং সকল ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডার (Tourism Stakeholder) বা পর্যটন দায়কগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা যায় এমন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।

২ : ৪ –  বিদ্যমান ও সম্ভাব্য সকল পর্যটন পণ্য চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিপণন নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন কৌশল পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করা।

২ : ৫ –  শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সাধারণ ও পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সাধন করতে সক্ষম এমন পর্যটন পরিকল্পনা নিশ্চিত করা।

২ :৬ –  সার্বিক পর্যটন উন্নয়ন, পর্যটন সেবার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, পর্যটন সেবা প্রদানকারীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ এবং ভোক্তা বা পর্যটকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম এমন বিষয়গুলোকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২: ৭ –  অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং প্রাপ্তি আরো সহজ করার কৌশল নির্ধারন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত করা।

২ : ৮ –  সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে নিয়মিত ও উচ্চ মানসম্পন্ন গবেষণার কোন বিকল্প নেই বিধায় উচ্চতর গবেষণা কাজ চালানো এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন অন্তর্ভূক্ত করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২ : ৯ –  আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাথে মানানসই পর্যটন শিক্ষা এবং মান সম্পন্ন প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে মানব সম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

২ : ১০ –  পর্যটন শিল্প অন্য সকল শিল্প থেকে আলাদা এবং অত্যন্ত গতিশীল বিধায ট্রায়াল এন্ড এরার মেথড (Trial & Error Method) পদ্ধতি চর্চা করা হয়ে থাকে। তাই, একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে পর্যবেক্ষণকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যাতে পরিকল্পনাটির যথার্থতা নিরূপন করা সম্ভব হয়।

০৩।  উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন  

যে কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নই একমাত্র সমাধান নয়। কেন না প্রণীত পরিকল্পনা যদি যথা সময়ে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা না যায় তাহলে সবকিছুই বিফলে যায়। অথচ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য একটি প্রধান সমস্যা। কেন না শুধু অর্থনৈতিকই নয় রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি প্রাকৃতিক তথা অপ্রত্যাশিত নানা সমস্যা বাস্তবায়নাধীন কর্মকাণ্ডকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ব্যহত করে। তবে, এসব সমস্যার কোন সমাধান নেই তাও নয়। কেন না অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবং ইচ্ছাশক্তিকে ব্যবহার করে তা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এজন্য পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত সরকারি-বেসরকারি এবং সর্বস্তরের সকলের ঐকান্তিকতা ও সহযোগীতা একান্ত আবশ্যক। অবশ্য এজন্য সরকার তথা সরকারি খাতকেই মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই পরিকল্পনামাফিক পর্যটন উন্নয়ন কাজ যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য যা যা করা দরকার তার মধ্যে রয়েছেঃ

৩ : ১ –  উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত কর্মকাগুগুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এবং সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে অগ্রাধিকার নিরূপন করা।

৩ : ২ –  পরিকল্পনাধীন এবং অগ্রাধিকার প্রাপ্ত সকল বিদ্যমান ও চালু কর্মসূচী সচল রাখা কিংবা মেয়াদ মধ্যে সমাপ্ত করার স্বার্থে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা।

৩ : ৩ – বিদ্যমান পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোর গুণগত মান, সাময়িক কিংবা অপ্রত্যাশিত কোন সমস্যা, দীর্ঘসূত্রীতার আশঙ্কা ইত্যাদি বিষয় পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা।

৩ : ৪ –  পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত সকল পক্ষ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি ইত্যাদির ভূমিকাকে সক্রিয় রাখার জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং সেল গঠন করা।

৩ : ৫ – সকল প্রকার কালক্ষেপণ, অপচয় এবং দুর্নীতি যা এই মন্ত্রণায়ের জন্য এক অশনীসংকেত তা যেকোন উপায়ে রোধ করা এবং পর্যটনের সুনাম অক্ষুন্ন রাখা।

০৪।  অর্থায়ন  

যে কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন তথা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এবং সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। অথচ নানা কারণে আমরা আমাদের পর্যটন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান এমনকি ব্যবহারও নিশ্চিত করতে সমর্থ হইনি। এজন্য যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব, খাতওয়ারী অর্থের চাহিদা নিরূপনে ব্যর্থতা, ফি বছর জাতীয় বাজেটের জন্য প্রস্তাবপত্র তৈরী করতে না পারা এবং বরাদ্দকৃত অর্থ খরচে অমার্জনীয় ব্যর্থতাই মূলত প্রধান সমস্যা হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি পর্যটন শিল্প উন্নয়নের গুরুত্ব এবং এই শিল্পের অন্তর্ভূক্ত খাতগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য আয় সম্পর্কে সরকারকে নিয়মিত অবহিত করতে না পারাটাও যোগ হয়েছে এর সাথে।

তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সংশ্লিষ্ট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার জন্য সরকারের সাথে রীতিমত দেনদরবার ও চাপ সৃষ্টি করতে হয়। আর এ কাজটি অনেক সময় রাজনৈতিক সরকার কিংবা প্রশাসনিক সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়না বিধায় বেসরকারি খাতকে ব্যবহার করা জরুরী হয়ে পড়ে। অথচ সে কাজটিও আজ পর্যন্ত আমরা করতে পারিনি বিধায় প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ থেকে একেবারেই বঞ্চিত থাকছি। তাই এই অকালকুষ্মাণ্ডতা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিবিগ্ন করার লক্ষে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৪ : ১ – যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের আগে সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে পর্যটনের জন্য এর অগ্রগণ্যতার যথার্থতা যাচাই করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন মেয়াদের কর্মকাণ্ডগুলো নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করা।

৪ : ২ –  উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত খাতগুলোর মধ্য থেকে স্বল্পমেয়াদভূক্ত কিংবা চলমান যেসব কর্মকাণ্ড/খাত/প্রকল্প ইত্যাদি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে ফি বছর এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদা নিরূপণ করা।

৪ : ৩ –  বাজেট বরাদ্দ অথবা থোক বরাদ্দ যেভাবেই হোক না কেন বিদ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  এবং বিপণন ও প্রচার বাধাহীনভাবে চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৪ : ৪ –  বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ কিংবা অন্য যে কোন খাত বা মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত অর্থ খাতওয়ারী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এবং যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং কমিটির মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

০৫।  আইন প্রণয়ন

আইন প্রণয়ন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন রাষ্ট্রেরই কাজ যা গদিনসীন সরকারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। তবে, একাজে সফলতার মুখ দেখতে হলে শৃঙ্খলা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা একান্ত অপরিহার্য। যা কিনা কেবলমাত্র যুতসই, বাস্তবসম্মত ও আধুনিক আইন প্রণয়ন এবং তা যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তাই সময়ে সময়ে এবং প্রয়োজনকে সামনে রেখে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সহায়ক আইন প্রণনের জন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৫ : ১ –  সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প এবং এই শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র সমুহ চিহ্নিত করা এবং বিদ্যমান আইন সমুহের কার্যকরীতা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা।

৫ : ২ – প্রয়োজনীয় ও নতুন আইনের খসড়া তৈরী এবং বিদ্যমান ও পরিবর্তনযোগ্য আইনের বিধান সমুহের  প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন চুড়ান্ত করার জন্য একটি সেল গঠন করা।

৫ : ৩ – পর্যটন উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে এমন সমস্যাগুলো দূর করা; পর্যটন আকর্ষণ ও গন্তব্য তথা এলাকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা;  পর্যটন সেবা সরবরাহকারীদের জন্য নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ;   সেবার গুণগত মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ;  ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণ; নিরাপদ ভ্রমণ;  মানব সম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন এবং বিধি-বিধান ও আচরণ-বিধি প্রণয়নে যে ঘাটতি রয়েছে তা চিহ্নিত করা এবং পূরণ করা।

৫ : ৪ –  নতুনভাবে প্রণীত ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি এসব আইনের পক্ষে জনসচেতনতা ও জনসমর্থন সৃষ্টির লক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

০৬।  পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণন 

প্রচারেই প্রসার। প্রচার ছাড়া কোন শিল্প কিংবা ব্যবসা শুধু যে অগ্রসর হতে পারেনা তা নয় এমন কি টিকে থাকতেও পারেনা। যেজন্য তথ্য প্রযুত্তির এই যুগে পর্যটন ব্যবসা একেবারেই প্রচার নির্ভর হয়ে পড়েছে। তার কারণ, অন্য শিল্পের ক্ষেত্রে পণ্য ভোক্তার কাছে সরাসরি নিয়ে যাওয়া যায় কিন্তু পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে তা মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্রে ভোক্তাকেই পণ্যের কাছে নিয়ে আসতে হয়। তাই এই শিল্পের প্রচার-প্রচারণা এবং বিপণন ও বিক্রয় প্রক্রিয়া অন্যান্য শিল্প থেকে আলাদা। এতেকরে পর্যটন পণ্যের উন্নয়ন থেকে শুরু করে বিপণন ও বিক্রয় ব্যবস্থাপনাকে এমনভাবে সাজানো হয় যে, ভোক্তা আর বাজারই মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে প্রাধান্য পায় নিজেদের পর্যটন পণ্য উপযোগী ভোক্তা তথা পর্যটক এবং লক্ষ্যবস্তু করা হয় পর্যটক যোগানদার সংশ্লিষ্ট দেশ বা দেশসমূহকে। তারপর চালানো হয় প্রচার-প্রচারণার নানাবিধ কার্যক্রম যা পরিকল্পিত বিপণনেরই একটি ধাপ। অথচ আমরা আমাদের পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও বিপণনের ক্ষেত্রে তা ঐভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। তাই আমাদের পর্যটন পণ্যের বৈশিষ্ট, প্রকৃতি, গুণাগুণ বা মান এবং নিজস্বতা বিবেচনায় নিয়েই কেবল কার্যকর ও ফলপ্রসু হয় এমন প্রচার-প্রচারণা আর বিপণন-বিক্রয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য যা যা করতে হবে তা হলোঃ

৬ ঃ ১ – স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, জনপ্রতিনিধি এবং সংবাদকর্মীদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করে পর্যটন পণ্য (পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্য ও কর্মকাণ্ড; পর্যটকরা যেসব সেবা গ্রহণ করেন এবং তাদের সন্তুষ্টি) চিহ্নিত করার কাজ সম্পন্ন করা এবং এসব পণ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং এর দায়িত্ব প্রদান করা।

৬ : ২ –  বিশ্বের প্রতিটি পর্যটক আকর্ষণকারী দেশই তার এক অথবা একাধিক পর্যটক আকর্ষণকে প্রধাণ হিসেবে চিহ্নিত করে তা পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমরা তা আজো করতে পারিনি বিধায় আমাদের এক অথবা একাধিক পর্যটক আকর্ষণকে প্রধাণ পর্যটক আকর্ষণ (Prime Tourist Attraction) হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। বাদবাকী পর্যটক আকর্ষণগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটন বাজার তথা ভোক্তা বা পযটকদের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে শ্রেণীকরণ (Classification)করে রাখতে হবে।

৬ : ৩ –  পর্যটন সেবার মান উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ একটি চলমান প্রক্রিয়া যা পর্যটক বা ভোক্তার চাহিদা ও পরিবর্তিত সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া চাই। তাই আজকালকার দুনিয়ায় একাজটির জন্য বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস (Quality Tourism Service) বা কিউটিএস (QTS) অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি পদ্ধতি। এটি চালু করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো বটে। কিন্তু নানা কারণে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি বিধায় এটি অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬ : ৪ –  পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  অনেকটা নাজুক ও পরনির্ভর প্রকৃতির বিধায় বিভিন্ন বিষয়ে শুধু পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কমিটি গঠনই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া, এসব বিষয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কোনভাবেই সুখকর নয়। তাই, যে কোন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ ও কমিটি গঠনের সাথে সাথে কর্মপরিধি ও সময়সীমা বেধে দেয়া একান্ত অপরিহার্য। আর তাই এসব বিষয়ে কোন ছাড় না দিয়ে যথা সময়ে ও নির্বিঘ্নে  লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিং সেল গঠন করে দায়িত্ব অর্পন করা।

৬ : ৫ –   পর্যটন শিল্পে সরকারি এবং বেসরকারি খাত একে অপরের পরিপূরক। এর মধ্যে বেসরকারি খাত যেহেতু প্রকৃত অর্থে পর্যটন পণ্য বিক্রী এবং সেবা প্রদানের সাথে সম্পৃক্ত সেহেতু মাঠের মানুষ হিসেবে তাদেরকেই পণ্য ও সেবার মূল বিক্রয়কারী বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। তাই পর্যটন পণ্যের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও বিপণনের সাথে বেসরকারী খাতের প্রতিটি সেবা বিভাগ যাদের ট্রেড অর্গানাইজেশন (Trade Organization) বা টিও লাইসেন্স রয়েছে তাদের সবাইকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া।

৬ : ৬ –  সামগ্রিকভাবে দেশে-বিদেশে পর্যটন শিল্পের প্রচার ও প্রসার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। কেন না কোন কোন পর্যটক আকর্ষণ বা গন্তব্য কিংবা পণ্য বা সেবা কোন কোন গন্তব্যের পর্যটকদের জন্য উপযোগী;  কোন কোন প্রচার মাধ্যম বা কি কি প্রচার সামগ্রী কিভাবে কতটুকু ব্যবহার করা হবে;  কোন কোন পর্যটন মেলায় কি কি প্রচার সামগ্রী নিয়ে কারা কারা অংশগ্রহণ করবেন;  কি কি প্রচার-কৌশল কিভাবে কোথায় কতটুকু ব্যবহার করা হবে;  কি কি বাজার ব্যবস্থাপনা কখন কিভাবে কোথায় কাজে লাগানো হবে ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন আসলেই অনেকটা জটিল ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত কাজ। তাই এজন্য সকল পর্যটন দায়কগোষ্ঠী বা ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডার (Tourism Stakeholder) সমন্বয়ে শুধুমাত্র অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি শক্তিশালী ষ্টিয়ারিং (Steering Committee) বা পরিচালন কমিটি গঠন করে দায়িত্ব অর্পন করা।

৬ : ৭ – আমাদের পর্যটন পণ্যের উপর ভিত্তি করে যেসব দেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসার জন্য তালিকাভূক্ত করা হবে সেসব দেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে পর্যটন প্রচারের জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যায়। প্রয়োজনে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে কিছু দূতাবাসের তাদের নিজস্ব কোন বিশেষ কর্মকর্তাকে পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্থায়ীভাবে অথবা পর্যটন মন্ত্রণায়ের প্রতিনিধি হিসেবে পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিকে স্থায়ীভাবে দায়িত্বে রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রকৃত পর্যটকদের জন্য তথ্য সরবরাহের পাশাপাশি ভিসা সহজীকরণের লক্ষে এয়ারপোর্ট এন্ট্রি ভিসা ও ই-ভিসার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা করা।

৬ : ৮ –  বলা হয়ে থাকে প্রথম অনুভূতিই শেষ অনুভূতি (First impression is the last impression)। তাই, বিদেশী পর্যটকদের বাংলাদেশে প্রবেশের প্রথম অভিজ্ঞতাকে আরো স্মৃতিময়, স্বার্থক-সুন্দর ও তথ্য সমৃদ্ব করার জন্য পর্যটকদের প্রধাণ প্রবেশ পথ যেমন বিমানবন্দর কিংবা স্থলবন্দরে সার্বক্ষণিক, তথ্য সমৃদ্ধ ও কার্যকর অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রবেশ পথে দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিবাসন কর্মকর্তাদের পর্যটন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

০৭। অন্যান্য 

একটি বিশাল, বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক শিল্প হিসেবে পর্যটনের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত যেমনি রয়েছে বিভিন্ন খাত, উপখাত, বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তেমনি রয়েছেন স্বার্থসংশ্লিষ্ট অংশীজন এবং নানাবিদ কর্মকাণ্ড  ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যা যথাযথভাবে সমন্বয় করে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করা না গেলে উন্নয়ন কাজ ব্যহত হয়। এমনকি অনেক সময় কালক্ষেপণের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মাঠে মারা যায়। এর মধ্যে বেশকিছু বিষয় রয়েছে যা এড়িয়ে যাবার তেমন কোন সুযোগ নেই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

৭ : ১ –  পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বহু বছর আগে অথচ শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি আজো। এমন কি পরবর্তীতে থ্রাষ্ট সেক্টর হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরও বিষয়টি গুরুত্ব পায় নি। অথচ সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন চাইলে শিল্প সহায়ক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা দরকার। তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এই শিল্পের সার্বিক ও স্বাভাবিক উন্নয়নের স্বার্থে চিহ্নিত শিল্প সহায়ক সুবিধাগুলো যেমন – জমি বরাদ্দ (সত্যিকার সৎ, অভিজ্ঞ ও দক্ষ উদ্যোক্তাদের মধ্যে);  বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ (অগ্রাধিকার ভিত্তিতে); আর্থিক সহায়তা (সহজ শর্তে ঋণ, স্বল্প সুদে ঋণ, প্রনোদনা);  কর অবকাশ (মাঝারি ও ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে);  কর রেয়াত (পর্যটন অবকাঠামো যেমন আবাসন, খাবার ও পানীয়, পর্যটন যান, বিনোদন ও ক্রীড়া সামগ্রী ইত্যাদি আমদানীর ক্ষেত্রে);  মুসক রেয়াত (ভ্রমণ, আবাসন, খাবার ও পানীয় ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে);  সুরা সরবরাহের অনুমতি (শুধুমাত্র কিউটিএস তালিকাভুক্ত ও বিদেশি পর্যটক সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য) এবং নিরাপত্তা ও শিল্পের পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

৭ : ২ –  মনে রাখতে হবে শিল্প সহায়ক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়ে গেলেই বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে তা নয়। এজন্য যা করতে হবে তা হলো পর্যটন অবকাঠামো যেমন আবাসন, পর্যটন যান, খাবার ও পানীয়, বিনোদন এবং পর্যটক পল্লী (Tourist Village) ও নিবিড় পর্যটক এলাকা বা বেষ্টনী (Exclusive Tourist Zone) ইত্যাদিতে দেশি-বিদেশি এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (Direct Foreign Investment) বৃদ্ধিকে সামনে রেখে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস বা ওএসএস (OSS) চালু করার পাশাপাশি পর্যটন বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা।

৭ :৩ -বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষে উন্নতমানের পর্যটন শিক্ষা এখন বিশ্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশেও ইদানীংকালে উচ্চ পর্যায়ে পর্যটন শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে যদিও এগুলোর গুণগত মান দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পর্যটন শিক্ষারও কোন সুযোগ নেই। তাই সর্বোস্তরে পর্যটন শিক্ষা চালু করণ, পাঠ্যসূচী প্রণয়ন/অনুমোদন, পর্যটন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য পর্যটন বিষয়ে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি “জাতীয় পর্যটন শিক্ষা কাউন্সিল” (National Tourism Education Council) গঠন করা।

৭ : ৪ –  পর্যটন যেহেতু শতভাগ সেবা নির্ভর একটি শিল্প সেহেতু এর প্রতিটি সেবা খাত মাঠ উপযোগী ও প্রয়োজন ভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নির্ভর হওয়ায় মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অথচ বাংলাদেশে মানসম্পন্ন পর্যটন প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে এটা মানতেই হয়। তাই, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পরিচালিত পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান “এনএইসটিটিআই”-কে আগেকার নামে অর্থাৎ “ট্যুরিজম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট” বা টিটিআই নামে অথবা “জাতীয় পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান” বা ন্যাশনাল ট্যুরিজম ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (National Tourism Training Institute)) নামে একটি আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ পর্যটন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা এবং সময়ের দাবী পূরণ করা।

৭ : ৫ – পর্যটন শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, চাকুরীদাতা এদের সমন্বয় এবং তাদের মধ্যেকার পারষ্পরিক সম্পর্ক ও স্বার্থ দেখভালের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সেল বা কমিশন (Cell/Commission) থাকা খুবই জরুরী। যাতে জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো স্তর অনুযায়ী জাতীয় সনদায়ন,  সকল স্তরে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণ,  চাকুরীর ব্যবস্থা গ্রহণ,  পর্যটন কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে পক্ষগুলোর মধ্যেকার পারষ্পরিক সম্পর্ক সমন্বয় করা সম্ভব হয়। যার উদ্দেশ্য থাকবে নিজ দেশের পর্যটন কর্মীদের চাকুরীর ব্যবস্থা করা এবং বিদেশিরা এসে চাকুরীর মাধ্যমে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া রোধ করা।

৭ : ৬ –   পর্যটন শিল্পের মত একটি শ্রেষ্ট শিল্প তথা ব্যবসা কোন অবস্থাতেই হিসাব ছাড়া চলতে পারেনা। অথচ মানতে হবে যে আমরা তাই নিয়ে চলছি। এজন্য পর্যটক আগমন-নির্গমন,  আয়-ব্যয়,  লোকবল ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যান তথা হিসাব সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিসহ জিডিপি (GDP)-তে পর্যটনের অবদান নিরূপনের জন্য অনতিবিলম্বে অবহেলায় ফেলে রাখা “ট্যুরিজম স্যাটেলাইট একাউন্ট” (Tourism Sattelite Account) বা টিএসএ (TSA) পদ্ধতিটির ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৭ : ৭ –  পর্যটন একটি শ্রমঘন ও বহুমাত্রিক শিল্প যার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। এমন এক শিল্পের সর্বশেষ ও নির্ভরযোগ্য যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত জানা না থাকলে এই শিল্পের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড,  শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ,  গবেষণা,  প্রচার-প্রচারণা এবং পর্যটকদের তাৎক্ষণিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর কাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, এমনিতেই তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যা আইন দ্বারা নিশ্চিত করা আছে। অথচ এমনই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় পর্যটনে শুধু অনুপস্থিতই নয় উপরন্তু আমরা নিশ্চুপ ও নির্বাক যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। তাই,  বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অনতিবিলম্বে “জাতীয় পর্যটন তথ্য ভাণ্ডার” (National Tourism Data Base) প্রতিষ্ঠা করা।

৭ : ৮ –   বলা হয়ে থাকে যে দেশ গবেষণায় যত উন্নত সে দেশও তত উন্নত। তাই দেখা যায় যে দেশে শিল্প-বাণিজ্য উন্নত সে দেশে গবেষণার বিষয়টিও উন্নত। এই বিবেচনায় পর্যটনের মত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পটির জন্য গবেষণা কর্ম কত গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমেয়। অথচ আমাদের এত সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের জন্য আজ পর্যন্ত গবেষণা কাজ চালানোর কোন উদ্যোগই নেয়া হয়নি। তাই কালবিলম্ব না করে প্রথমে একটি “পর্যটন গবেষণা সেল” (Tourism Research Cell) গঠন করে কার্যক্রম শুরু করা এবং পর্যায়ক্রমে তা “জাতীয় পর্যটন গবেষণা ইন্সটিটিউট” (National Tourism Research Institute)-এ রূপান্তর করা।

৭ : ৯ –   আমাদের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে দেশি-বিদেশি ব্যক্তি,  প্রতিষ্ঠান,  দাতা সংস্থা,  এনজিও ইত্যাদি তাদের সাহায্য ও সহযোগীতার হাত প্রসারিত করতে পারেন এবং কেউ কেউ করছেনও। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য,  পরিকল্পনা ও কার্যক্রম ইত্যাদি বিস্তারিত জানা না থাকলে পর্যটন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করা যেমনি সম্ভব হয়না তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা, বিশৃঙ্খলা এমনকি ভুল বোঝাবোঝিরও সৃষ্টি হয়। তাই এসব সাহায্যকারী কিংবা সহায়তাদানকারী যারাই বাংলাদেশের ভিতর বিভিন্ন ধরণের পর্যটন কার্যক্রম চালাচ্ছেন বা চালাতে ইচ্ছুক তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অথবা জানানো বাধ্যতামূলক করা।

৭ : ১০ –  ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফ বি সি সি আই (FBCCI) ব্যবসায়ীদের নের্তৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় এবং শিল্পের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের সাথে আইনানুগ সম্পর্ক বজায় রেখে দেশে-বিদেশে কাজ করে থাকে। তার সাথে ট্রেড অর্গানাইজেশন বা টি ও (TO) লাইসেন্সপ্রাপ্ত পর্যটন সমিতিগুলোও নিবিঢ়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে বিধায় এফ বি সি সি আইসহ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর,  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,  বিনিয়োগ বোর্ড,  বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ,  রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো এর মত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজন মোতাবেক পর্যটন উন্নয়ন সহযোগী করার পাশাপাশি বিশেষ করে বিনিয়োগ, শিল্প সহায়ক সুবিধা এবং প্রচার ও বিপণনে অংশীদার হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭ : ১১ – পর্যটন একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত তথা বহুমাত্রিক এবং শতভাগ সেবা নির্ভর শিল্প হওয়ায় এর সাথে অনেকগুলো সেবা ভিত্তিক ব্যবসা যেমন যানবাহন,  আবাসন,  খাবার ও পানীয়,  বিনোদন,  ট্র্যভেল ও ট্যুরস ইত্যাদি সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে। তাদের সাথের আইনি সম্পর্ককে শুধু নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সত্যিকার দায়কগোষ্ঠী সম্পর্ক বা স্টেকহোল্ডার রিলেশন (Stakeholder Relation) গড়ে তুলে একদিকে যার যার সেবার প্রকৃতি ভেদে তাদের ব্যবসায় বিরাজিত সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সাথে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আবার অন্যদিকে প্রতিটি সমিতিকে সমানভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে পর্যটন উন্নয়নের সত্যিকার অংশীদার হিসেবে তাদেরকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে কাজে লাগানো।

৭ : ১২ – বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও কিছু ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত থেকে এবং দেশে-বিদেশে কাজ করে সার্বিকভাবে পর্যটন বিষয়ে প্রচুর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি সরাসরি অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অবসরে চলেগেছেন বা চলে যাবেন। এমনসব বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মানুষদের তাদের লব্দ অভিজ্ঞতা আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটনের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েকজনকে বাছাই করে সার্বিক পর্যটন শিল্পে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে জাতীয়ভাবে সম্মানিত করে “ট্যুরিজম এলিট প্যানেল” (Tourism Elite Panel – TEP) এর মত একটি প্যানেলভুক্ত করে রাখা। যাতে নীতি নির্ধারণ কিংবা পর্যটনের যেকোন বিষয়ে এবং যে কোন সময়ে তাদের মতামত বা পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, পর্যটন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও বহুমাত্রিক শিল্প। এর একদিকে রয়েছে বিভিন্ন খাত-উপখাত, সেবা প্রদানকারী,  সেবা গ্রহণকারী,  উন্নয়ন সহযোগী ও অন্যান্য অংশীদার এবং অন্যদিকে রয়েছে পর্যটন আকর্ষণ ও গন্তব্য এবং পর্যটন সেবা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এই যে এক মহাসম্মিলনী তার ভালোমন্দ সবকিছু এই ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে আনা কঠিন। কেন না এটি শতভাগ সেবা নির্ভর এবং দ্রুত পরিবর্তন ও পরিবর্ধনশীল এক শিল্প মাধ্যম যাকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় এবং চাহিদা পূরণ করতে হয়। এর মধ্যেই আমাদেরকে এই শিল্পের বিকাশের স্বার্থে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। অতএব টেকসই পর্যটন উন্নয়নকে সামনে রেখে অন্তত এই কাজগুলো করা গেলে বাকীটা সময়ই বলে দেবে কখন কিভাবে কি করতে হবে। তাতেই আমরা আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটনকে উন্নয়নের সড়ক এমন কি মহাসড়কেও নিয়ে যেতে পারবো।

লেখকঃ চেয়ারম্যান,  সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)