ঢাকা ০৫:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ট্যুর অপারেটরদের সৃষ্টিশীলতা

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৪:০৬:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
  • ৯ বার পড়া হয়েছে

জামিউল আহমেদ ::  ধানমণ্ডির কোন এক রেস্তোরাঁয় একটি অনুষ্ঠান শেষে বাইরে এসে দেখি রাস্তা বেশ ফাঁকা। ঈদের ছুটির রেশ না কাটায় এমনটি হয়েছিলো। তাই এই সুযোগে পাশের ২৭ নম্বর সড়ক দিয়ে হাঁটতে গেলাম। প্রথমেই চোখে পড়লো দেয়ালের গ্রাফিতিগুলো। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন প্রচণ্ড আক্রমণ, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, প্রাণ বিসর্জন এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করেই এসব গ্রাফিতি দেয়ালে স্থান পেয়েছিল। যা কিনা দেশের ভিতরে এমনকি দেশের বাইরেও ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল এবং হৃদয়গ্রাহী উৎসুক্যের সৃষ্টি করেছিল। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতে এই গ্রাফিতিগুলো অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে বা গেছে।

তাই ঐদিন এসব গ্রাফিতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পর আমার মধ্যে কিছুটা হলেও ক্রিয়া করেছিল। যেজন্য এগুলোর কিছু ছবি তুলে নিয়ে এসে ঐদিনই ফেসবুকে একটি পোষ্টই দিয়ে শেয়ার করেছিলাম। এতে অনেকেই তাদের সুন্দর মতামত তুলে ধরেন। তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আমার এক সহপাঠী বন্ধু মন্তব্যের পাশাপাশি আমাকে পর্যটনের মধ্যে থাকতে পরামর্শ দেন। তার ভাবনায় ছিল, এর দ্বারা আমি হয়তো দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটি যে তা নয় এবং পর্যটনের সাথে এই গ্রাফিতিগুলো সরাসরি সম্পৃক্ত তা তাকে জানিয়ে দিলাম। তার সাথে এও জানালাম পর্যটনের প্রায় সিংহভাগই সমাজবিজ্ঞান দখল করে আছে। এমন কি পর্যটন গবেষক এবং বোদ্ধাদের একটি বিরাট অংশ হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

পর্যটনের কাজ হচ্ছে মানুষের ভ্রমণকে আরো সাশ্রয়ী, উপভোগ্য ও অর্থবহ করার পাশাপাশি জানার ও শেখার সুযোগ করে দেয়া। এজন্য যা করতে হয় তা হলো পর্যটন সম্পদগুলোকে চিহ্নিত করা। আর এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং সে দেখতে ও জানতে আগ্রহী হয়। তাই এসব সম্পদ চিহ্নিত হয়ে গেলে এগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্যে রূপান্তর করতে হয়। তারপর এই পণ্যগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো একত্রিত করে প্যাকেজ তৈরীর মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে যারা তুলে ধরেন তারা হচ্ছেন ট্যুর অপারেটর এবং ট্যুর অরগানাইজার। তারা আবার একাজে ট্র্যাভেল এজেন্টদেরও সাহায্য নিয়ে থাকেন।

এখানে এই গ্রাফিতিগুলো হচ্ছে পর্যটনের জন্য মূল্যবান সম্পদ। এগুলোর প্রয়োজনীয় উন্নয়ন অর্থাৎ পর্যটন উপযোগী কাজগুলো সম্পাদন করে পণ্যে রূপান্তর করার দায়িত্ব সরকার তথা পর্যটনের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের। তারপর এই পণ্যগুলোর জন্য টার্গেট মার্কেট বা সম্ভাব্য বাজার চিহ্নিত করে ব্যাপক বিপণন ও প্রচার কাজ চালাতে হয়। তাই এই পর্যায় থেকে ট্যুর অপারেটররা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হয়ে যান। তারা এসব পণ্যের সাথে পর্যটকদের চাহিদা অনু্যায়ী বিভিন্ন সেবা যেমন পর্যটন যান, আবাসন, খাবার-দাবার, বিনোদন ইত্যাদি যুক্ত করে প্যাকেজ তৈরীর মাধ্যমে একক মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। আর এজন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতকেই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যৌথভাবে এসব পর্যটন সম্পদকে পর্যটনের জন্য কাজে লাগাবেন। এতে একদিকে দেশ তার প্রচার পাবে অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং তা পর্যটনের উন্নয়নে সাহায্যে আসবে।

অথচ এদের যার যার অবস্থানগত ব্যর্থতার জন্য আমরা এমন একটি সুন্দর সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললাম। আর এজন্য বরাবরের মত আনাড়ি সরকার এবং স্বার্থপর আমলাদের দায়ী করা যায় বটে। তবে, প্রথমে তাদের নিজেদের এবং পরে দেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আমাদের ট্যুর অপারেটরদের এই দায়ভার একটু বেশিই নিতে হবে। কেন না তারা নিজেরা একটু আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গিয়ে অনভিজ্ঞ সরকারি খাতকে তাদের দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনে পরামর্শ ও সাহায্য- সহায়তা দিয়ে কাজে লাগাতে পারতেন। তবে, এজন্য দরকার ট্যুর অপারেটরদের নিজেদের পেশাদারিত্ব এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। যার মূলে রয়েছে ট্যুর অপারেটরদের তাদের নিজেদের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত ও পেশাদারিত্ব শক্তি যাকে এক কথায় বলা হয় তাদের মধ্যেকার ক্রিয়েটিভিটি বা “সৃষ্টিশীলতা”।

সৃষ্টিশীলতা হচ্ছে, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান বের করা। বলা যায় এটি একটি ধারণা, একটি কাজ, একটি আবিষ্কার বা অন্য যেকোনো কিছু হতে পারে যা আগে বিদ্যমান ছিল না। যা দ্বারা একজন ট্যুর অপারেটর তার যোগ্যতা এমনকি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কেন না ট্যুর অপারেটরের কাজ হচ্ছে পর্যটন পণ্যকে বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ব্র্যান্ডিং তথা সংকেতীকরণ বা নামকরণ করা। কিন্তু যদি এই কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে তিনি পর্যটকদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্ল্যানিং, ডিজাইনিং, কষ্টিং ইত্যাদি কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে প্যাকেজ তৈরী এবং সর্বশেষ মার্কেটিং এর কাজটি করবেন। তারপর ট্যুর সিডিউল অনুযায়ী একজন ট্যুর গাইড ট্যুরিস্টদের নিয়ে গিয়ে ট্যুরটি বাস্তবায়ন করবেন। এক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি সামনে আসবে যখন একটি পণ্যের ব্র্যান্ডিং তথা নামকরণের প্রয়োজন হবে তখন। এজন্য বিশ্বজনীনভাবে ব্যবহৃত ও গ্রহণযোগ্য অন্তত দুই শতাধিক পণ্যের ব্র্যান্ড নাম থেকে একটি পছন্দ করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করাটাই হচ্ছে একজন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটরের কৃতিত্বের কাজ।

যা দ্বারা গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন প্রচণ্ড আক্রমণ, অত্যাচার, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, প্রাণ বিসর্জন এবং তৎপরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক ধরণের ট্যুর হতে পারতো। এসব সম্ভাব্য ট্যুরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং ট্যুর, রিয়ালিটি ট্যুর, জেনোসাইড ট্যুর, স্পেশাল ইন্টারেস্ট ট্যুর, এক্সপেরিয়েনশিয়াল ট্যুর, পলিটিক্যাল ট্যুর, এজুকেইশনাল ট্যুর, ডার্ক বা ব্ল্যাক বা থানা ট্যুর, স্টরি টেলিং ট্যুর ইত্যাদি। অবশ্য এসব ট্যুরের সম্ভাবনা কিন্তু একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। যে কেউ যিনি একজন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটর তিনি নিজ উদ্যোগে এই কাজটি যে কোন সময় করতে পারতেন এবং চাইলে এখনো পারবেন।

তবে, আমাদের দেশে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন এমন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটর হিসেবে এখনো কেউ এগিয়ে আসেননি কিংবা চেষ্টাটুকুও করেননি। আবার অনেকের ইচ্ছা থাকলেও তাদের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে এসব থাকার পরও অনেকে সাহস করে এগিয়ে আসছেন না। অর্থাৎ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন “বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে”? যেজন্য বাংলাদেশে এখনো সেই সেকেলে ট্যুর অপারেটর পদ্ধতি চালু রয়েছে। যেমন একই ব্যক্তি একাধারে ট্যুর অপারেটর, ট্যুর অরগানাইজার, ট্যুরিস্ট গাইড এমন কি ট্র্যাভেল এজেন্টও। যেজন্য দেখা যায় একজন প্রতিষ্ঠিত ট্যুর অপারেটর তিনি আবার নিজে ট্যুর গাইড সমিতিরও প্রধান। যা দুনিয়ার কোথাও নেই তাই, আন্তর্জাতিকভাবে এসব সমিতির গ্রহণযোগ্যতাও নেই। অবশ্য বহু চড়াই- উতরাইয়ের পর আমাদের দেশেও এখন পৃথক ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড আইন হয়েছে। এবার দেখতে হবে এমন পরিস্থিতিতে অন্তত কোন পরিবর্তন হয় কি না বা কোথায় গিয়ে পৌঁছে।

তবে, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অন্তত যারা শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ তাদের এগিয়ে আসা দরকার। আবার বিশেষ করে পর্যটনের উচ্চ-শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র ও শিক্ষকদেরও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এজন্য শিক্ষকদেরও শুধু শেখানোর জন্য শেখানোর মত সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে মডার্ন এন্ড নিড বেসড তথা আধুনিক ও প্রয়োজন ভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেখানে এসব সৃষ্টিশীল বিষয়কে আমলে নেয়া হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মাঠ উপযোগী তথা হাতে কলমে শেখার সুযোগ পাবে। যা তাদের চাকুরী ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে আগেকার মত পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয় নতুনকে আবিষ্কারে সাহায্য করবে। তা থেকে পাওয়া যাবে শুধু এরকম সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটরই নয় তার সাথে সর্বস্তরে দক্ষ পর্যটন কর্মীও। তাতে একদিকে যেমনি এরকম গণঅভ্যুত্থানের মত মূল্যবান পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটন পণ্যগুলো অবহেলিত, অরক্ষিত এবং অব্যবহৃত থাকবেনা তেমনি দেশে বিদেশি পর্যটক আসার যে বন্ধ্যত্ব তাও আস্তে আস্তে ঘুচতে থাকবে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)

 

 

 

 

 

 

ট্যাগস :

ট্যুর অপারেটরদের সৃষ্টিশীলতা

আপডেট সময় ০৪:০৬:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

জামিউল আহমেদ ::  ধানমণ্ডির কোন এক রেস্তোরাঁয় একটি অনুষ্ঠান শেষে বাইরে এসে দেখি রাস্তা বেশ ফাঁকা। ঈদের ছুটির রেশ না কাটায় এমনটি হয়েছিলো। তাই এই সুযোগে পাশের ২৭ নম্বর সড়ক দিয়ে হাঁটতে গেলাম। প্রথমেই চোখে পড়লো দেয়ালের গ্রাফিতিগুলো। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন প্রচণ্ড আক্রমণ, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, প্রাণ বিসর্জন এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করেই এসব গ্রাফিতি দেয়ালে স্থান পেয়েছিল। যা কিনা দেশের ভিতরে এমনকি দেশের বাইরেও ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল এবং হৃদয়গ্রাহী উৎসুক্যের সৃষ্টি করেছিল। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতে এই গ্রাফিতিগুলো অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে বা গেছে।

তাই ঐদিন এসব গ্রাফিতির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পর আমার মধ্যে কিছুটা হলেও ক্রিয়া করেছিল। যেজন্য এগুলোর কিছু ছবি তুলে নিয়ে এসে ঐদিনই ফেসবুকে একটি পোষ্টই দিয়ে শেয়ার করেছিলাম। এতে অনেকেই তাদের সুন্দর মতামত তুলে ধরেন। তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে আমার এক সহপাঠী বন্ধু মন্তব্যের পাশাপাশি আমাকে পর্যটনের মধ্যে থাকতে পরামর্শ দেন। তার ভাবনায় ছিল, এর দ্বারা আমি হয়তো দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটি যে তা নয় এবং পর্যটনের সাথে এই গ্রাফিতিগুলো সরাসরি সম্পৃক্ত তা তাকে জানিয়ে দিলাম। তার সাথে এও জানালাম পর্যটনের প্রায় সিংহভাগই সমাজবিজ্ঞান দখল করে আছে। এমন কি পর্যটন গবেষক এবং বোদ্ধাদের একটি বিরাট অংশ হচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

পর্যটনের কাজ হচ্ছে মানুষের ভ্রমণকে আরো সাশ্রয়ী, উপভোগ্য ও অর্থবহ করার পাশাপাশি জানার ও শেখার সুযোগ করে দেয়া। এজন্য যা করতে হয় তা হলো পর্যটন সম্পদগুলোকে চিহ্নিত করা। আর এই সম্পদের মধ্যে রয়েছে যা মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং সে দেখতে ও জানতে আগ্রহী হয়। তাই এসব সম্পদ চিহ্নিত হয়ে গেলে এগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্যে রূপান্তর করতে হয়। তারপর এই পণ্যগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো একত্রিত করে প্যাকেজ তৈরীর মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে যারা তুলে ধরেন তারা হচ্ছেন ট্যুর অপারেটর এবং ট্যুর অরগানাইজার। তারা আবার একাজে ট্র্যাভেল এজেন্টদেরও সাহায্য নিয়ে থাকেন।

এখানে এই গ্রাফিতিগুলো হচ্ছে পর্যটনের জন্য মূল্যবান সম্পদ। এগুলোর প্রয়োজনীয় উন্নয়ন অর্থাৎ পর্যটন উপযোগী কাজগুলো সম্পাদন করে পণ্যে রূপান্তর করার দায়িত্ব সরকার তথা পর্যটনের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের। তারপর এই পণ্যগুলোর জন্য টার্গেট মার্কেট বা সম্ভাব্য বাজার চিহ্নিত করে ব্যাপক বিপণন ও প্রচার কাজ চালাতে হয়। তাই এই পর্যায় থেকে ট্যুর অপারেটররা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হয়ে যান। তারা এসব পণ্যের সাথে পর্যটকদের চাহিদা অনু্যায়ী বিভিন্ন সেবা যেমন পর্যটন যান, আবাসন, খাবার-দাবার, বিনোদন ইত্যাদি যুক্ত করে প্যাকেজ তৈরীর মাধ্যমে একক মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। আর এজন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতকেই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যৌথভাবে এসব পর্যটন সম্পদকে পর্যটনের জন্য কাজে লাগাবেন। এতে একদিকে দেশ তার প্রচার পাবে অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং তা পর্যটনের উন্নয়নে সাহায্যে আসবে।

অথচ এদের যার যার অবস্থানগত ব্যর্থতার জন্য আমরা এমন একটি সুন্দর সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললাম। আর এজন্য বরাবরের মত আনাড়ি সরকার এবং স্বার্থপর আমলাদের দায়ী করা যায় বটে। তবে, প্রথমে তাদের নিজেদের এবং পরে দেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আমাদের ট্যুর অপারেটরদের এই দায়ভার একটু বেশিই নিতে হবে। কেন না তারা নিজেরা একটু আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গিয়ে অনভিজ্ঞ সরকারি খাতকে তাদের দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনে পরামর্শ ও সাহায্য- সহায়তা দিয়ে কাজে লাগাতে পারতেন। তবে, এজন্য দরকার ট্যুর অপারেটরদের নিজেদের পেশাদারিত্ব এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। যার মূলে রয়েছে ট্যুর অপারেটরদের তাদের নিজেদের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত ও পেশাদারিত্ব শক্তি যাকে এক কথায় বলা হয় তাদের মধ্যেকার ক্রিয়েটিভিটি বা “সৃষ্টিশীলতা”।

সৃষ্টিশীলতা হচ্ছে, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমস্যার সমাধান বের করা। বলা যায় এটি একটি ধারণা, একটি কাজ, একটি আবিষ্কার বা অন্য যেকোনো কিছু হতে পারে যা আগে বিদ্যমান ছিল না। যা দ্বারা একজন ট্যুর অপারেটর তার যোগ্যতা এমনকি শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কেন না ট্যুর অপারেটরের কাজ হচ্ছে পর্যটন পণ্যকে বাজারের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ব্র্যান্ডিং তথা সংকেতীকরণ বা নামকরণ করা। কিন্তু যদি এই কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে তিনি পর্যটকদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্ল্যানিং, ডিজাইনিং, কষ্টিং ইত্যাদি কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে প্যাকেজ তৈরী এবং সর্বশেষ মার্কেটিং এর কাজটি করবেন। তারপর ট্যুর সিডিউল অনুযায়ী একজন ট্যুর গাইড ট্যুরিস্টদের নিয়ে গিয়ে ট্যুরটি বাস্তবায়ন করবেন। এক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি সামনে আসবে যখন একটি পণ্যের ব্র্যান্ডিং তথা নামকরণের প্রয়োজন হবে তখন। এজন্য বিশ্বজনীনভাবে ব্যবহৃত ও গ্রহণযোগ্য অন্তত দুই শতাধিক পণ্যের ব্র্যান্ড নাম থেকে একটি পছন্দ করে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করাটাই হচ্ছে একজন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটরের কৃতিত্বের কাজ।

যা দ্বারা গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান সময়কালীন প্রচণ্ড আক্রমণ, অত্যাচার, রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, প্রাণ বিসর্জন এবং তৎপরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক ধরণের ট্যুর হতে পারতো। এসব সম্ভাব্য ট্যুরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং ট্যুর, রিয়ালিটি ট্যুর, জেনোসাইড ট্যুর, স্পেশাল ইন্টারেস্ট ট্যুর, এক্সপেরিয়েনশিয়াল ট্যুর, পলিটিক্যাল ট্যুর, এজুকেইশনাল ট্যুর, ডার্ক বা ব্ল্যাক বা থানা ট্যুর, স্টরি টেলিং ট্যুর ইত্যাদি। অবশ্য এসব ট্যুরের সম্ভাবনা কিন্তু একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। যে কেউ যিনি একজন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটর তিনি নিজ উদ্যোগে এই কাজটি যে কোন সময় করতে পারতেন এবং চাইলে এখনো পারবেন।

তবে, আমাদের দেশে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন এমন সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটর হিসেবে এখনো কেউ এগিয়ে আসেননি কিংবা চেষ্টাটুকুও করেননি। আবার অনেকের ইচ্ছা থাকলেও তাদের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে এসব থাকার পরও অনেকে সাহস করে এগিয়ে আসছেন না। অর্থাৎ অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন “বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাধবে কে”? যেজন্য বাংলাদেশে এখনো সেই সেকেলে ট্যুর অপারেটর পদ্ধতি চালু রয়েছে। যেমন একই ব্যক্তি একাধারে ট্যুর অপারেটর, ট্যুর অরগানাইজার, ট্যুরিস্ট গাইড এমন কি ট্র্যাভেল এজেন্টও। যেজন্য দেখা যায় একজন প্রতিষ্ঠিত ট্যুর অপারেটর তিনি আবার নিজে ট্যুর গাইড সমিতিরও প্রধান। যা দুনিয়ার কোথাও নেই তাই, আন্তর্জাতিকভাবে এসব সমিতির গ্রহণযোগ্যতাও নেই। অবশ্য বহু চড়াই- উতরাইয়ের পর আমাদের দেশেও এখন পৃথক ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড আইন হয়েছে। এবার দেখতে হবে এমন পরিস্থিতিতে অন্তত কোন পরিবর্তন হয় কি না বা কোথায় গিয়ে পৌঁছে।

তবে, বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে অন্তত যারা শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ তাদের এগিয়ে আসা দরকার। আবার বিশেষ করে পর্যটনের উচ্চ-শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র ও শিক্ষকদেরও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। এজন্য শিক্ষকদেরও শুধু শেখানোর জন্য শেখানোর মত সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে মডার্ন এন্ড নিড বেসড তথা আধুনিক ও প্রয়োজন ভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেখানে এসব সৃষ্টিশীল বিষয়কে আমলে নেয়া হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা মাঠ উপযোগী তথা হাতে কলমে শেখার সুযোগ পাবে। যা তাদের চাকুরী ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে আগেকার মত পুরাতনকে আঁকড়ে ধরে থাকা নয় নতুনকে আবিষ্কারে সাহায্য করবে। তা থেকে পাওয়া যাবে শুধু এরকম সৃষ্টিশীল ট্যুর অপারেটরই নয় তার সাথে সর্বস্তরে দক্ষ পর্যটন কর্মীও। তাতে একদিকে যেমনি এরকম গণঅভ্যুত্থানের মত মূল্যবান পর্যটন সম্পদ তথা পর্যটন পণ্যগুলো অবহেলিত, অরক্ষিত এবং অব্যবহৃত থাকবেনা তেমনি দেশে বিদেশি পর্যটক আসার যে বন্ধ্যত্ব তাও আস্তে আস্তে ঘুচতে থাকবে।

লেখকঃ চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)

 

 

 

 

 

 


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/obhibason/public_html/wp-includes/functions.php on line 5471