ঢাকা ০৫:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৫:১৭:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

অভিবাসন ডেস্ক :: ছয় লক্ষ টাকা খরচে সব প্রক্রিয়া শেষে পেয়েছিলেন মালয়েশিয়ার ভিসা। ভেবেছিলেন প্রবাসে কাজ করে ঘুরবে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু বিমানের টিকেট না পাওয়াসহ শেষ মুহুর্তের নানা জটিলতায় যাওয়া হয়নি স্বপ্নের গন্তব্যে। এখন রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করছেন নওগাঁর সাব্বির আহমেদ।

ভিসা হওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা আরেক কর্মী দিনাজপুরের মহসিন হোসেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, প্রবাসে পাড়ি জমাতে, ফসলি জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। কিন্তু পূরণ হয়নি সেই আশা। বরং দেনা পরিশোধ করতে না পেরে প্রায় এক বছর আর বাড়িতে ফেরেননি তিনি।

এমনকি রিক্রুটিং এজেন্সি, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেও উদ্ধার করতে পারেননি খরচ হওয়া একটি টাকাও। ২০২৪ সালের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর আন্দোলন-বিক্ষোভ করেও বিষয়টির কোনো সুরাহা করতে পারেননি এই কর্মীরা।

সব মিলিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটছে, বৈধ ভিসা পাওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা হাজারো কর্মীর।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের আগস্টে চালু হওয়ার পর ওই দফায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিমান টিকেট না পাওয়া, রিক্রুটিং এজেন্টের গাফিলতিসহ নানা কারণে দেশটিতে যেতে ব্যর্থ হন প্রায় ১৭ হাজার কর্মী।

বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ বৃহৎ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্প্রতি আবারো চালু করার চেষ্টা করছে সরকার। গত ১৪ মে মালয়েশিয়ায় দেশটির সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

যাতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে আবারো। যে প্রক্রিয়া এগোবে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার মাধ্যমে। কারণ মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কোন কোন খাতে কত সংখ্যক কর্মী নেবে সেই সিদ্ধান্ত হবে ওই বৈঠকেই।

কিন্তু এখানেও ঘুরেফিরে আসছে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ। যা নিয়ে বিভক্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারো কারো অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় যাওয়া কর্মীদের কয়েকগুণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

এছাড়া অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কিংবা দালালের দৌরাত্ম, এমন নানা কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বারবারই সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশের কর্মীরা।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে বাংলাদেশের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা নতুন নয়।

সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ রেখে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না বলেই মনে করেন অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে কী করছে সরকার?

অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবারো চালু করতে সম্প্রতি তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ঢাকায় ২১ ও ২২ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা।

যেখানে মালয়েশিয়া সরকারের ১৪ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। যদিও সেখান থেকে নতুন কোন ঘোষণা আসেনি।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও, নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

অবশ্য বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ও বৈষম্যের সুযোগ রাখা হবে না বলেও জানান সিদ্দিকী।

এর আগে গত ১৪ মে মালয়েশিয়া সফর করেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র ও মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ সভায় অংশ নেন তিনি।

পরে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কেওয়ংয়ের বরাত দিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে মালয়েশিয়া।

প্রথম দফায় ৭ হাজার ৯২৬ জন কর্মীকে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও ভিডিও বার্তায় জানান উপদেষ্টা।

সিন্ডিকেট ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে।

গত ১৯ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট ইস্যুতে বায়রার এক পক্ষের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে কর্মীদের বাড়তি অর্থও ব্যয় হচ্ছে। কম খরচে কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট প্রক্রিয়া বন্ধের বিকল্প নেই বলেই মত তার।

ফখরুল ইসলাম জানান, টানা চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ১০০ এজেন্সি নিয়ে চক্র গঠন করে একটি গোষ্ঠী। কর্মীপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দিলেও গড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে কর্মীকে।

বারবার অনিয়মের অভিযোগ করার পরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে সে জন্যই সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে বলেও দাবি ফখরুল ইসলামের।

বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া কেন এজেন্সি ঠিক করে দেবে এমন প্রশ্নও তোলেন ফখরুল ইসলাম।

যদিও সিন্ডিকেটের বিষয়টি সঠিক নয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান বায়রার সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।

তিনি বলছেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি নির্ধারিত হয়। বাজার স্থিতিশিল রাখতে শ্রমবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ বলেই মনে করেন আবুল বাশার।

তিনি বলছেন, বেশি সুবিধা পেতেই একটি পক্ষ সিন্ডিকেট ইস্যু সামনে আনছে। এর ফলে অতীতেও বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়েছে।

সিন্ডিকেট শব্দটি যেভাবে এলো?

২০১৫ সালে ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়েছিল মালয়েশিয়া। যা সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। পরে জিটুজি প্লাস নামের এই পদ্ধতিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় দেশটি।

এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন হলেও তা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। প্রথমে ২৫ এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে এটি বাড়িয়ে ১০০ এজেন্সি করা হয়।

এই চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে মালয়েশিয়াতেও বেসরকারি এজেন্সির একটি চক্র গঠে ওঠার অভিযোগ রয়েছে।

অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কখনোই স্থিতিশীল ছিল না। ১৯৯২ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তির কয়েক বছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালে আবার সে দেশের শ্রমবাজার চালু হয়।

এরপর ২০০০ সালে নিজেদের চাহিদা বিবেচনায় সে দেশের সরকার বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়।

২০০৬ সালে আবারো কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ার পর ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়।

এরপর দু’দেশের মধ্যে আলোচনার পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আবার নতুন চুক্তি হয়। ওই বছরের নভেম্বর মাসে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে আবার বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু করে।

২০১৫ সালে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। যা সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে সেটিও বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকার কর্মী প্রেরণ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্বারক সই করে। তবে তারপরও কর্মী নিয়োগ বন্ধ ছিল। কারণ মালয়েশিয়ার তরফ থেকে শুধুমাত্র ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের সরকারও বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত জানায়। এরপর থেকে ছয় মাস যাবত দুই দেশের সরকারের মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালি হয় এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক বারবার মালয়েশিয়ার তরফ থেকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।

ওই বছরের জুন মাসের দুই তারিখ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানানের উপস্থিতিতে ঢাকায় দুই দেশের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বিষয়টির এক ধরনের সুরাহা হয়।

বাংলাদেশ সরকার সেসময় ১৫৬১ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠায়। সেখান থেকে মালয়েশিয়া সরকার তাদের কেবিনেটে ১০১ এজেন্সির নাম অনুমোদন করে।

২০২১ সালে একটি সমঝোতা চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ার ঠিক করে দেওয়া ১০২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে দেশটিতে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩১ মে বাংলাদেশের জন্য আবারও বন্ধ হয় বাজারটি। মালয়েশিয়া যেতে পারলেও অনেকে কর্মী নির্ধারিত কাজে যোগ দিতে পারেননি এমন অভিযোগও উঠেছিল সেবার ।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ইতিহাস

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের জনশক্তি নিয়োগের চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে।

বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের পরেই বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

বিএমইটির ওয়েবসাইটে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়। পরের বছর কোন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে না গেলেও ১৯৮০ সালে মাত্র তিনজন শ্রমিক যায় দেশটিতে।

এরপরের দুই বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়নি কোনো বাংলাদেশি। দুই বছর বাদে আবার ১৯৮৩ সালে ২৩ জন মালয়েশিয়াতে যায়। এরপর ১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ ৫৩০ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়।

এই ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের যাতায়াত চলে।

তবে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই দেশের বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সময় এ শ্রমবাজার বন্ধ হলেও এখন পর্যন্ত শুধু ২০২৩ সালেই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ শ্রমিক গিয়েছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট, (রামরু) এর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ রেখে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।

সমঝোতা স্মারকে থাকা, এজেন্সি বাছাইয়ে মালয়েশিয়ার একক ক্ষমতার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন মিজ. তাসনিম। তার মতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আবারো প্রবেশের আগে এই শর্তটি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।

তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে প্রবাসী কর্মীদের অতীতের চেয়েও বেশি টাকা ব্যয় করতে হবে। যাতে রপ্তানি প্রক্রিয়াটি আবারো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

অন্য দেশগুলোকে মালয়েশিয়া যে শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন হতে পারে না বলেই মত তাসনিমের। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে যে সমস্যা আছে অন্য দেশেও তা বিদ্যমান।

অনেকদিন পর বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক শ্রমবাজারটি খোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করেন আরেক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির।

ট্যাগস :

মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?

আপডেট সময় ০৫:১৭:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ জুন ২০২৫

অভিবাসন ডেস্ক :: ছয় লক্ষ টাকা খরচে সব প্রক্রিয়া শেষে পেয়েছিলেন মালয়েশিয়ার ভিসা। ভেবেছিলেন প্রবাসে কাজ করে ঘুরবে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু বিমানের টিকেট না পাওয়াসহ শেষ মুহুর্তের নানা জটিলতায় যাওয়া হয়নি স্বপ্নের গন্তব্যে। এখন রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করছেন নওগাঁর সাব্বির আহমেদ।

ভিসা হওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা আরেক কর্মী দিনাজপুরের মহসিন হোসেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, প্রবাসে পাড়ি জমাতে, ফসলি জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। কিন্তু পূরণ হয়নি সেই আশা। বরং দেনা পরিশোধ করতে না পেরে প্রায় এক বছর আর বাড়িতে ফেরেননি তিনি।

এমনকি রিক্রুটিং এজেন্সি, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেও উদ্ধার করতে পারেননি খরচ হওয়া একটি টাকাও। ২০২৪ সালের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর আন্দোলন-বিক্ষোভ করেও বিষয়টির কোনো সুরাহা করতে পারেননি এই কর্মীরা।

সব মিলিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটছে, বৈধ ভিসা পাওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা হাজারো কর্মীর।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের আগস্টে চালু হওয়ার পর ওই দফায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিমান টিকেট না পাওয়া, রিক্রুটিং এজেন্টের গাফিলতিসহ নানা কারণে দেশটিতে যেতে ব্যর্থ হন প্রায় ১৭ হাজার কর্মী।

বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ বৃহৎ এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্প্রতি আবারো চালু করার চেষ্টা করছে সরকার। গত ১৪ মে মালয়েশিয়ায় দেশটির সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।

যাতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে আবারো। যে প্রক্রিয়া এগোবে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার মাধ্যমে। কারণ মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কোন কোন খাতে কত সংখ্যক কর্মী নেবে সেই সিদ্ধান্ত হবে ওই বৈঠকেই।

কিন্তু এখানেও ঘুরেফিরে আসছে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ। যা নিয়ে বিভক্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারো কারো অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় যাওয়া কর্মীদের কয়েকগুণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

এছাড়া অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কিংবা দালালের দৌরাত্ম, এমন নানা কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বারবারই সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশের কর্মীরা।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে বাংলাদেশের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা নতুন নয়।

সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ রেখে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না বলেই মনে করেন অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে কী করছে সরকার?

অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবারো চালু করতে সম্প্রতি তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ঢাকায় ২১ ও ২২ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা।

যেখানে মালয়েশিয়া সরকারের ১৪ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। যদিও সেখান থেকে নতুন কোন ঘোষণা আসেনি।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও, নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

অবশ্য বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ও বৈষম্যের সুযোগ রাখা হবে না বলেও জানান সিদ্দিকী।

এর আগে গত ১৪ মে মালয়েশিয়া সফর করেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র ও মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ সভায় অংশ নেন তিনি।

পরে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কেওয়ংয়ের বরাত দিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে মালয়েশিয়া।

প্রথম দফায় ৭ হাজার ৯২৬ জন কর্মীকে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও ভিডিও বার্তায় জানান উপদেষ্টা।

সিন্ডিকেট ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে।

গত ১৯ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট ইস্যুতে বায়রার এক পক্ষের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে কর্মীদের বাড়তি অর্থও ব্যয় হচ্ছে। কম খরচে কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট প্রক্রিয়া বন্ধের বিকল্প নেই বলেই মত তার।

ফখরুল ইসলাম জানান, টানা চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ১০০ এজেন্সি নিয়ে চক্র গঠন করে একটি গোষ্ঠী। কর্মীপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দিলেও গড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে কর্মীকে।

বারবার অনিয়মের অভিযোগ করার পরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে সে জন্যই সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে বলেও দাবি ফখরুল ইসলামের।

বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া কেন এজেন্সি ঠিক করে দেবে এমন প্রশ্নও তোলেন ফখরুল ইসলাম।

যদিও সিন্ডিকেটের বিষয়টি সঠিক নয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান বায়রার সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।

তিনি বলছেন, দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি নির্ধারিত হয়। বাজার স্থিতিশিল রাখতে শ্রমবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ বলেই মনে করেন আবুল বাশার।

তিনি বলছেন, বেশি সুবিধা পেতেই একটি পক্ষ সিন্ডিকেট ইস্যু সামনে আনছে। এর ফলে অতীতেও বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়েছে।

সিন্ডিকেট শব্দটি যেভাবে এলো?

২০১৫ সালে ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়েছিল মালয়েশিয়া। যা সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। পরে জিটুজি প্লাস নামের এই পদ্ধতিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেয় দেশটি।

এরপর দুই দেশের মধ্যে অনেক আলোচনার পর ২০২২ সালের আগস্টে আবার শ্রমবাজার খুলে দেওয়া হয়। সব এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত রাখার আন্দোলন হলেও তা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। প্রথমে ২৫ এজেন্সি দায়িত্ব পেলেও পরে এটি বাড়িয়ে ১০০ এজেন্সি করা হয়।

এই চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে মালয়েশিয়াতেও বেসরকারি এজেন্সির একটি চক্র গঠে ওঠার অভিযোগ রয়েছে।

অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কখনোই স্থিতিশীল ছিল না। ১৯৯২ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তির কয়েক বছর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালে আবার সে দেশের শ্রমবাজার চালু হয়।

এরপর ২০০০ সালে নিজেদের চাহিদা বিবেচনায় সে দেশের সরকার বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়।

২০০৬ সালে আবারো কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ার পর ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়।

এরপর দু’দেশের মধ্যে আলোচনার পর ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আবার নতুন চুক্তি হয়। ওই বছরের নভেম্বর মাসে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘জিটুজি’ পদ্ধতিতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে আবার বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়া যাওয়া শুরু করে।

২০১৫ সালে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয় মালয়েশিয়া। যা সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে সেটিও বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সরকার কর্মী প্রেরণ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্বারক সই করে। তবে তারপরও কর্মী নিয়োগ বন্ধ ছিল। কারণ মালয়েশিয়ার তরফ থেকে শুধুমাত্র ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের সরকারও বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত জানায়। এরপর থেকে ছয় মাস যাবত দুই দেশের সরকারের মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালি হয় এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক বারবার মালয়েশিয়ার তরফ থেকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।

ওই বছরের জুন মাসের দুই তারিখ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানানের উপস্থিতিতে ঢাকায় দুই দেশের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বিষয়টির এক ধরনের সুরাহা হয়।

বাংলাদেশ সরকার সেসময় ১৫৬১ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠায়। সেখান থেকে মালয়েশিয়া সরকার তাদের কেবিনেটে ১০১ এজেন্সির নাম অনুমোদন করে।

২০২১ সালে একটি সমঝোতা চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়ার ঠিক করে দেওয়া ১০২টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে দেশটিতে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩১ মে বাংলাদেশের জন্য আবারও বন্ধ হয় বাজারটি। মালয়েশিয়া যেতে পারলেও অনেকে কর্মী নির্ধারিত কাজে যোগ দিতে পারেননি এমন অভিযোগও উঠেছিল সেবার ।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ইতিহাস

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের জনশক্তি নিয়োগের চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে।

বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের পরেই বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

বিএমইটির ওয়েবসাইটে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়। পরের বছর কোন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে না গেলেও ১৯৮০ সালে মাত্র তিনজন শ্রমিক যায় দেশটিতে।

এরপরের দুই বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়নি কোনো বাংলাদেশি। দুই বছর বাদে আবার ১৯৮৩ সালে ২৩ জন মালয়েশিয়াতে যায়। এরপর ১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ ৫৩০ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়।

এই ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের যাতায়াত চলে।

তবে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই দেশের বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সময় এ শ্রমবাজার বন্ধ হলেও এখন পর্যন্ত শুধু ২০২৩ সালেই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ শ্রমিক গিয়েছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট, (রামরু) এর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ রেখে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।

সমঝোতা স্মারকে থাকা, এজেন্সি বাছাইয়ে মালয়েশিয়ার একক ক্ষমতার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন মিজ. তাসনিম। তার মতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আবারো প্রবেশের আগে এই শর্তটি অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।

তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে প্রবাসী কর্মীদের অতীতের চেয়েও বেশি টাকা ব্যয় করতে হবে। যাতে রপ্তানি প্রক্রিয়াটি আবারো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

অন্য দেশগুলোকে মালয়েশিয়া যে শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন হতে পারে না বলেই মত তাসনিমের। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে যে সমস্যা আছে অন্য দেশেও তা বিদ্যমান।

অনেকদিন পর বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক শ্রমবাজারটি খোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে করেন আরেক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির।


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/obhibason/public_html/wp-includes/functions.php on line 5471