ঢাকা ১২:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবনের চিরমুক্তি

  • নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০২:১৫:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৭ বার পড়া হয়েছে

আজিজুল পারভেজ :: বিদায় দাউদ হায়দার! ভর্তি পরীক্ষায় যাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি কার লেখা? ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ভাইভা বোর্ডে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়:
— বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ — এটা কার কবিতা?
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন:
— আমারই লেখা।
বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কারণ এমন একটি কবিতা এর রকম কোনো যুবক লিখতে পারেন তা তাদের ধারণায় ছিল না। কিন্তু পরে যখন তারা তার আগের কিছু লেখা দেখেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পারেন, তখন দাউদ হায়দারকে মেধার জন্য বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেন। নথিপত্র অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর!
আলোচিত কবিতাটির ক’টি লাইন:
‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’

২.
দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি যাকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দৈনিক সংবাদ এর সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতায় হযরত মোহাম্মদ [স.], যিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। [সংস্‌ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত থাকতে পারে।] প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)। কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
কবি দাউদ হায়দারের ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ কবিতায় ‘কিছু বিতর্কিত বক্তব্য’ থাকলেও অসাধারণ কিছু লাইনও আছে:
‘আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আর কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।’

৩.
কলকাতা ছিল দাউদ হায়দারের কাছে একদম অচেনা বিদেশ, যেখানে কাউকেই চিনতেন না। এর আগে তিনি বিদেশ যাননি। দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে একা কাঁদছিলেন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ এর কাছে প্রথম আশ্রয় পান। একমাসের মতো ছিলেন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। লেখালেখি শুরু করেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যে’ ভর্তি হন।

৪.
বাংলাদেশের কোনো সরকারই তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামল। এরপর ভারত সরকারও তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”

নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এলে পুরো ঘটনা শুনেন। তিনি ফিরে গিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবিকে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ জুলাই ১৯৮৭ থেকে তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে অবস্থান করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকুরী করেন।

৫.
দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় সাহসী উচ্চারণে কলাম লিখেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

৬.
দাউদ হায়দার ছিলেন এক রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান। তাঁর সব ভাই-ই বিখ্যাত, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বড় ভাই জিয়া হায়দার নাটকের লোক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসাধারণসব বই প্রকাশ করেছেন। আমার ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিও আছে উনার সঙ্গে। মাকিদ হায়দার কবি। খুবই সজ্জন লোক ছিলেন। তাঁরা সবাই প্রয়াত। আছেন কবি জাহিদ ও আরিফ। কনিষ্ঠ আরিফ হায়দার Arif Haider আমাদের সিনিয়র বন্ধু। নাটকের মানুষ। ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকের উপর পড়াশুনা করেছেন। ঢাকায় শংকর সাওজালের কারক নাট্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপক। আমাদের ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাট্যগুরু মাজহারুল হক পিন্টুর Mazhar Pintu ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে আমাদেরও ঘনিষ্ঠতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অসংখ্য দিন রাত আমাদের কেটেছে আড্ডায়। মাঝে মধ্যে দেখা হয়। কিন্তু বিখ্যাত হায়দার পরিবারের একেকজন তারকা নক্ষত্রের খসে পড়ার সংবাদ এলে তাকে ফোন দেই। বেদনাকে শেয়ার করি। সংস্কৃতি বিট কভার করার কারণে বাড়তি তথ্য সংগ্রহের জন্যও নির্দয়ভাবে নানা প্রশ্ন করতে হয়।
আজ ঘুম ভাঙতেই শুনলাম। দাউদ হায়দার আর নেই। শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে মারা যান। হাসপাতালে দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। লাইভসাপোর্ট তুলে নিলে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করেন। চিরমুক্তি ঘটে নির্বাসিত জীবনের।
ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, শেষ বিচারের মালিক আল্লাহ। তিনিই তাঁর বান্দার ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।
এবার আর আরিফ ভাইকে ফোন দিতে ইচ্ছে করেনি। জানতাম তিনি কলকাতায়। তারপরও ফেসবুকে সমবেদনা জানাই। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আরিফ ভাই লিখেছেন, ‘খোকন ভাই (নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে…।’ এরপর ভাইয়ের সঙ্গে কিছু ছবি শেয়ার দিয়েছেন, যেগুলো ২০২৩ সালের, কলকতার।

৭.
দেশে ফেরার প্রবল আকুতি ছিল দাউদ হায়দারের। অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন একদিন সময় হবে পদ্মা ইচ্ছামতি গাঙ্গ শালিকের দেশে ফেরার। সময় কি আর হবে? হলেও তো মাতৃভূমিতে শায়িত হওয়ার বাসনা তার পূরণ হবে না।
১৯৮৩ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়।
‘…মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশে ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে
চিৎকার ক’রে
আকাশ ফাটিয়ে বলি;
দেখো, সীমান্তে ওইপাশে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।’
আসলেই মানুষ সব সময়ই একা।
বিদায় দাউদ হায়দার।

ট্যাগস :

সিলেট থেকে প্রথম বারের মতো শুরু হলো কার্গো ফ্লাইট

কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবনের চিরমুক্তি

আপডেট সময় ০২:১৫:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫

আজিজুল পারভেজ :: বিদায় দাউদ হায়দার! ভর্তি পরীক্ষায় যাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি কার লেখা? ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে দাউদ হায়দার নামক এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ভাইভা বোর্ডে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়:
— বল তো, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ — এটা কার কবিতা?
তিনি হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন:
— আমারই লেখা।
বোর্ডের শিক্ষকরা প্রথমে অবাক হয়েছিলেন, কারণ এমন একটি কবিতা এর রকম কোনো যুবক লিখতে পারেন তা তাদের ধারণায় ছিল না। কিন্তু পরে যখন তারা তার আগের কিছু লেখা দেখেন এবং তার প্রতিভা বুঝতে পারেন, তখন দাউদ হায়দারকে মেধার জন্য বিশেষভাবে মূল্যায়ন করেন। নথিপত্র অনুসারে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া কবির বয়স তখন ছিল মাত্র ১৭ বছর!
আলোচিত কবিতাটির ক’টি লাইন:
‘আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।’

২.
দাউদ হায়দার দেশের প্রথম কবি যাকে কবিতা লেখার জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দৈনিক সংবাদ এর সাহিত্য পাতায় ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতায় হযরত মোহাম্মদ [স.], যিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। [সংস্‌ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত থাকতে পারে।] প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
১৯৭৩ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে ভারতের কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)। কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’
কবি দাউদ হায়দারের ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ কবিতায় ‘কিছু বিতর্কিত বক্তব্য’ থাকলেও অসাধারণ কিছু লাইনও আছে:
‘আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আর কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।’

৩.
কলকাতা ছিল দাউদ হায়দারের কাছে একদম অচেনা বিদেশ, যেখানে কাউকেই চিনতেন না। এর আগে তিনি বিদেশ যাননি। দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে একা কাঁদছিলেন। সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ এর কাছে প্রথম আশ্রয় পান। একমাসের মতো ছিলেন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। লেখালেখি শুরু করেন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যে’ ভর্তি হন।

৪.
বাংলাদেশের কোনো সরকারই তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখায়নি। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন ছিল জিয়াউর রহমানের শাসনামল। এরপর ভারত সরকারও তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”

নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এলে পুরো ঘটনা শুনেন। তিনি ফিরে গিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে নির্বাসিত কবিকে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ জুলাই ১৯৮৭ থেকে তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে অবস্থান করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেও বিফল হন। বার্লিন যাত্রায় তিনি পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেন। পরে এই ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকুরী করেন।

৫.
দাউদ হায়দার প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। দাউদ হায়দারের কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা, নির্বাসনের কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতা-চেতনা, দ্রোহ এবং মানবতাবাদী চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় সাহসী উচ্চারণে কলাম লিখেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

৬.
দাউদ হায়দার ছিলেন এক রত্নগর্ভা মায়ের সন্তান। তাঁর সব ভাই-ই বিখ্যাত, লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বড় ভাই জিয়া হায়দার নাটকের লোক। রশীদ হায়দার কথাসাহিত্যিক, গবেষক। বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অসাধারণসব বই প্রকাশ করেছেন। আমার ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিও আছে উনার সঙ্গে। মাকিদ হায়দার কবি। খুবই সজ্জন লোক ছিলেন। তাঁরা সবাই প্রয়াত। আছেন কবি জাহিদ ও আরিফ। কনিষ্ঠ আরিফ হায়দার Arif Haider আমাদের সিনিয়র বন্ধু। নাটকের মানুষ। ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকের উপর পড়াশুনা করেছেন। ঢাকায় শংকর সাওজালের কারক নাট্যসম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার অধ্যাপক। আমাদের ইউনিভার্সেল থিয়েটারের নাট্যগুরু মাজহারুল হক পিন্টুর Mazhar Pintu ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে আমাদেরও ঘনিষ্ঠতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অসংখ্য দিন রাত আমাদের কেটেছে আড্ডায়। মাঝে মধ্যে দেখা হয়। কিন্তু বিখ্যাত হায়দার পরিবারের একেকজন তারকা নক্ষত্রের খসে পড়ার সংবাদ এলে তাকে ফোন দেই। বেদনাকে শেয়ার করি। সংস্কৃতি বিট কভার করার কারণে বাড়তি তথ্য সংগ্রহের জন্যও নির্দয়ভাবে নানা প্রশ্ন করতে হয়।
আজ ঘুম ভাঙতেই শুনলাম। দাউদ হায়দার আর নেই। শনিবার (২৭ এপ্রিল ২০২৫) রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে মারা যান। হাসপাতালে দীর্ঘদিন কোমায় ছিলেন। লাইভসাপোর্ট তুলে নিলে তিনি অনন্তের পথে যাত্রা করেন। চিরমুক্তি ঘটে নির্বাসিত জীবনের।
ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুসারে, শেষ বিচারের মালিক আল্লাহ। তিনিই তাঁর বান্দার ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।
এবার আর আরিফ ভাইকে ফোন দিতে ইচ্ছে করেনি। জানতাম তিনি কলকাতায়। তারপরও ফেসবুকে সমবেদনা জানাই। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আরিফ ভাই লিখেছেন, ‘খোকন ভাই (নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার) আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে…।’ এরপর ভাইয়ের সঙ্গে কিছু ছবি শেয়ার দিয়েছেন, যেগুলো ২০২৩ সালের, কলকতার।

৭.
দেশে ফেরার প্রবল আকুতি ছিল দাউদ হায়দারের। অপেক্ষার প্রহর গুণেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন একদিন সময় হবে পদ্মা ইচ্ছামতি গাঙ্গ শালিকের দেশে ফেরার। সময় কি আর হবে? হলেও তো মাতৃভূমিতে শায়িত হওয়ার বাসনা তার পূরণ হবে না।
১৯৮৩ সালে কলকাতায় অবস্থানকালে কবি দেশান্তরী হওয়ার গভীর বেদনার কথা লিখেছেন ‘তোমার কথা’ কবিতায়।
‘…মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশে ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে
চিৎকার ক’রে
আকাশ ফাটিয়ে বলি;
দেখো, সীমান্তে ওইপাশে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।’
আসলেই মানুষ সব সময়ই একা।
বিদায় দাউদ হায়দার।


Notice: ob_end_flush(): failed to send buffer of zlib output compression (0) in /home2/obhibason/public_html/wp-includes/functions.php on line 5471