কানপুর টেস্টের পুরো ফোকাস ছিল সাকিব আল হাসানের ওপর। বাঁহাতি অলরাউন্ডার তাঁর শেষ অ্যাওয়ে টেস্টে কেমন খেলেন, সেদিকে ছিল সবার মনোযোগ। বল হাতে ৪ উইকেট পেলেও তাঁর রান না পাওয়াটা ছিল গত দু’দিনের চর্চিত বিষয়। বিদেশের শেষটা ভালো হয়নি সাকিবের, দলও ভালো করেনি। বৃষ্টি আড়াই দিন খেয়ে নেওয়া ম্যাচেও দুরন্ত দাপটে ফল বের করে নিয়েছে ভারত। আদতে ৭ উইকেটের জয়টা ভারত দু’দিনেই তুলে নিয়েছে। টেস্টকে টি২০ বানিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ার খেলায় মেতেছিলেন রোহিত শর্মারা। ভারতের কাছে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারায় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট টেবিলের চার থেকে সাতে নেমে গেছে বাংলাদেশ। এক মাসের ব্যবধানে প্রশংসার সূচকেও পতন হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় এভাবে দলের ভরাডুবি নিয়ে।
পাকিস্তানে দুর্দান্ত একটি সিরিজ খেলার পর ভারতে ভালো কিছুর আশা করা হয়েছিল। নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের কথায় ছিল আত্মবিশ্বাসের ছাপ। টেস্ট স্কোয়াডের ১৬ জনই বিশ্বাস করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিরিজ হবে। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। ভারতের বিপক্ষে ভালো কিছু দেখার আশায় তাকিয়ে ছিলেন দেশের মানুষ। অথচ দুই টেস্টেই হতাশ করা পারফরম্যান্স উপহার দিলেন শান্তরা। কানপুরে তো কোনোরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেননি। সাকিব তাই মন খারাপ করেই বিদায় নিয়েছেন শেষ অ্যাওয়ে টেস্ট খেলে।
এই সিরিজে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দু’দলের পার্থক্য বোঝাতে র্যাঙ্কিংকে বারবার টেনে এনেছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটাররাও সেটিকে কখনও কখনও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন ব্যর্থতা আড়াল করতে। কখনও সামান্য সাফল্যে কৃতিত্ব নেওয়ার প্রয়োজনে। কিন্তু দিন শেষে বাজেভাবে ম্যাচ হেরে হাসির পাত্র হয়েছেন শান্তরা। সিরিজ শুরুর আগে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটিকে দেখছেন সামর্থ্যের চেকলিস্ট হিসেবে। চেন্নাই ও কানপুরে বাংলাদেশ যে ‘ব্র্যান্ডের’ ক্রিকেট খেলেছে, তাতে ভালোর বক্সে টিক পড়েনি। বরং কানপুরে মানহীন ক্রিকেট প্রদর্শনী লজ্জায় ফেলেছে। যদিও শান্তদের ড্রেসিংরুমে ওসবের বালাই নেই। খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখেন তারা। তাই তো সিরিজ নির্ধারণী দ্বিতীয় টেস্ট দুই দিনে হেরেও বিচলিত নন কেউ। সমর্থকদের ‘লজ্জা লজ্জা’ বলে চিৎকার শোনার সময় কোথায়? তারা বরং তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন এসব শুনে!
গ্রিন পার্কে বাংলাদেশের শুরুটা ভালোই ছিল। বৃষ্টিভেজা প্রথম দিন শেষ করেছিল তিন উইকেটে ১০৭ রানে। তারাই কিনা চতুর্থ দিনে অলআউট ২৩৩ রান করে। প্রথম ইনিংসে কিছুটা লড়াই জমাতে পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে শ্রীহীন পারফরম্যান্স মেনে নেওয়ার নয়। মূলত চেন্নাইয়ের ব্যাটিংয়ের পুনরাবৃত্তি হয়েছে কানপুরে। শুধু প্রথমের জায়গায় দ্বিতীয় আর দ্বিতীয়র জায়গায় প্রথম ইনিংসে ওলটপালট করে নিলেই হলো। তাতেই ৯৯ শতাংশ মিলে যাবে। চেন্নাই টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেছিল ১৪৯ রান, কানপুরে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৬ রান। চেন্নাইয়ের দ্বিতীয় ইনিংস ছিল ২৩৪ রানের, কানপুরের প্রথম ইনিংস ২৩৩ রানের। পার্থক্য শুধু একটাই মুমিনুল হকের সেঞ্চুরি পাওয়া।
বাংলাদেশ ২৬ রানে পিছিয়ে থেকে শেষ দিন খেলতে নামে। নেমেই হোঁচট খেতে হয় মুমিনুল হকের আউটে। দলের ২৬ কে ৩৬ রানে নিয়ে জুটির বিচ্ছেদ। প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান মুমিনুল দ্বিতীয় ইনিংসে ২ রানে রবিচন্দ্র অশ্বিনের শিকার। বাঁহাতি এ ব্যাটারের আউটের মধ্য দিয়ে ভাঙনের শুরু। সৈকতে বালির বাঁধ ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার মতো গঙ্গাপাড়ের গ্রিন পার্কে আউটের ঢলে ভেসে গেছে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। সাদমান ১০১ বলে টেনেটুনে ৫০ রান করে আউট। মুশফিকু রহিম ৬৩ বলে ৩৭। বাকিদের রান লেখার মতো কিছু না। এক সেশনে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৪৬ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ।
টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ দল অস্ট্রেলিয়ার পরই ভারত। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের টেবিলে তারা আবার প্রথম। র্যাঙ্কিং দিয়ে নয়, ভারতকে মূল্যায়ন করতে হবে মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। রীতিমতো ভিনগ্রহের ক্রিকেট খেলছে তারা। পেস ও স্পিন মিলিয়ে সম্পূর্ণ প্যাকেজ। আর ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য বর্ণনা করে শেষ করার নয়। টেস্ট ক্রিকেটেও যে নিখাদ টি২০র বিনোদন দেওয়া যায়, কানপুরে হাজার বিশেক দর্শকের সামনে তা গত দু’দিন দেখিয়েছে ভারত। গ্রিন পার্কের জনসমুদ্রে সমর্থনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। রবিচন্দ্র অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা ও জাসপ্রিত বুমরাহ– এ বোলিংত্রয়ী প্রতিপক্ষকে দ্রুত অলআউট করে দেওয়ায় ৯৫ রানের লক্ষ্য পায় ভারত। যশস্বী জয়সোয়ালের হাফ সেঞ্চুরিতে (৫১) ১৭.২ ওভারেই ম্যাচ জিতে নেয় স্বাগতিকরা। (সমকাল)