রোমেনা রোজী :: ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলে চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়কে ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ।
এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ১০২টি উপজেলা। তবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, খেপুপাড়া, ভোলা, টেকনাফ। ১৯৯১ সালের এই ঝড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং প্রায় সমপরিমাণ মানুষ আহত হয়। এই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ‘ অপারেশন সি এঞ্জেল ‘ – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশগুলি পরিচালনা করে , যা এখন পর্যন্ত পরিচালিত বৃহত্তম সামরিক ত্রাণ প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে একটি। এই অপারেশন কার্যক্রমে লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন কর্নেল (অবঃ) মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীক। তাঁরই স্মৃতিচারণে ‘অপারেশন সি এঞ্জেল’ নিয়ে জানবো।
আজ থেকে ৩৪ বছর আগের স্মৃতিচারণায় কর্ণেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন অনেক কিছু হয়তো দিন তারিখ অনুযায়ী হবেনা, তারপরও যতটুকু সম্ভব তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
এই ঘূর্ণিঝড় এতো প্রলয়ংকরী আর ধ্বংসাত্মক ছিলো যে, তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনীকে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য আদেশ প্রদান করে। কিন্তু এতো ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে যে, তৎকালীন সরকার অনুধাবন করতে পারলো বৈদেশিক সাহায্য দরকার অতিদ্রুত।
এতবড় একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ, দুর্গত মানুষের সাহায্যে, উপকূলীয় অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে তৎকালীন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার প্রায় দুই মাসের মাথায় বড় ধরনের এ দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেয়ে মার্কিন সাহায্য চেয়ে পাঠান। কর্ণেল সালাম বলেন, তিনি শুনেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া টেলিফোন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়রকে সাহায্যের জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ডাকে সাড়া দেয় এবং এতে নৌ, মেরিন সেনারা বিপুলভাবে অংশ নেওয়ায় এই সহায়তা কার্যক্রমে মূলত মার্কিন তৎপরতাই ছিল বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দুর্যোগ ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় এ ত্রাণ তৎপরতার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সি এঞ্জেল’। বাংলাদেশে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূতরা নিজেদের দেশে সাহায্যের জন্য খবর পাঠান।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের আদেশ পেয়ে মে মাসের ১০ তারিখ থেকে মার্কিন মেরিন, নৌ, সেনাবাহিনী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সমন্বয়ে সাত হাজার সদস্যের টাস্কফোর্স বাংলাদেশে অবতরণ করতে শুরু করে। এর নেতৃত্ব দেওয়া হয় জাপানের ওকিনাওয়ায় অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির থ্রি মেরিন এক্সপেডিশনারি ব্রিগেডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরি সি. স্টাকপোলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-সেনাদের এম্ফিবিয়াস টাস্কফোর্স (এটিএফ) ১৫ টি জাহাজ ও ২৫০০ সোলজারসহ তখন ইরাকযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর বঙ্গোপসাগর হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরও বাংলাদেশের সহায়তার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল স্টাকপোল চট্টগ্রামে এসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত থাকায় ত্রাণ তৎপরতায় তখন বেশি জরুরি মাধ্যম মেরিন হেলিকপ্টার, দ্রুতগামী এলসিএসি (ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এয়ার কুশন) উভচর যানযোগে প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপ, ভোলা, হাতিয়া, বাঁশখালী প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠাতে শুরু করেন। এ তৎপরতায় মার্কিন নেতৃত্বে অন্যান্য বিদেশি সহায়তাকারী জাপান, যুক্তরাজ্য, বিভিন্ন এনজিও কেয়ার, অক্সফাম প্রভৃতিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে। তখনকার আমেরিকার রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তখনকার মন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) অলি আহমদের ঐসময়ের কর্মতৎপরতার কথা বলেন।
বাংলাদেশে পৌঁছার পরে মার্কিন টাস্কফোর্সকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী থেকে ৪০ জন অফিসারকে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। তখন সেনাবাহিনীতে মেজর হিসেবে কর্মরত কর্ণেল (অবঃ) সালাম নিজের আগ্রহের কথা জানান এবং লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে মার্কিন টাস্কফোর্সের কাজের সাথে যোগ দেন। চট্টগ্রাম পোর্টে যেখানে মার্কিন টাস্কফোর্স কাজ করছে ঐখানে রিপোর্ট করেন কর্ণেল সালাম। তখন উনাকে তারা প্ল্যানিং সেলে কাজ করার জন্য নিয়ে যান। লেঃ জেনারেলের স্ট্যাকপোলের তত্ত্বাবধানে প্ল্যানিং সেলের কাজ চলতো। সেখানে কর্ণেল সালাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ত্রাণসহায়তা কার্যক। শুরুতে খুব বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিলো ত্রাণ সহায়তায়। প্ল্যানিং সেলের মিটিংগুলোতে উপস্থিত থেকে প্রতিদিনের একটা সার্ভের মাধ্যমে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমের একটা ম্যাপিং করা হয়। প্রতিটা এলাকায় একটা করে রিলিফ অপারেশন সেল করা হয়। প্রত্যেকটা রিলিফ অপারেশন তারওয়া শীপ থেকে পরিচালনা করা হতো। উনার মতে আমেরিকার দক্ষতার জন্যই এই দূর্যোগ মোকাবিলা করা সহজ হয়েছিলো। আমেরিকান সদস্য যারা কাজ করেছেন তাদের একাগ্রতা ছিল খুব, যেটা ঐ সময় তিনি অনুধবন করেছেন। ১ মাস ১০ দিন ছিলেন কর্ণেল (অবঃ) ঐ টাস্কফোর্সের সাথে। তাঁর কাজের জন্য তাঁকে টাস্কফোর্সের সদস্যরা খুব এপ্রিসিয়েশন করেছে।
বাংলাদেশ আর্মির সাথে ঐ অপারেশনে একসাথে কাজ করার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সম্পর্ক আরো বেশি মজবুত হয়েছে বলে কর্ণেল সালাম মনে করেন। ২০২১ সালে করোনায় লেঃ জেনারেল স্ট্যাকপোলের মারা গেছেন, সবশেষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান।