মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল :: বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে ধীরে ধীরে অতীত হয়ে যাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। ২৬ সেপ্টেম্বর টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে দিলেন বিদায়ের ঘোষনা। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের শেষ ম্যাচটা গেল বিশ^কাপে খেলে ফেললেও লাল বলের শেষ ম্যাচ কবে খেলবেন নাকি খেলে ফেলেছেন সে বিষয়ে এখনো ধোয়াশা রয়েছে। কানপুর টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটাই কি শেষ না কি মিরপুরে দক্ষিন আফ্রিকার বিপক্ষেও মাঠে নামতে পারবেন সেটা এখনো যদি কিন্তুর উপর নির্ভর করছে। অনেকবারই বলেছেন, গাড়ির ড্রাইভার হয়ে থাকার দিন ফুরিয়ে যাওয়ায় আর দুই ফরম্যাটে খেলার প্রয়োজনীয়তা না দেখার কারণেই বিদায়ের ঘোষনা। যদিও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অন্যতম ফেরিওয়ালা হয়ে কেন এই ফরম্যাটকে বিদায় বললেন সেটা একটা প্রশ্নও বটে। তবে মাঠে নন্দিত সাকিব মাঠের বাইরে নানা কারণেই নিন্দিত হয়ে থাকবেন। একজন সাকিব বিশ^ ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়িয়ে যে রেকর্ডে নিজের নাম তুলেছেন সেটা আর কোন বাংলাদেশিই পারেনি। দেশ থেকে দেশের বাইরে, মিরপুর থেকে ওয়েলিংটন, সবখানেই চলেছে সাকিব রাজ। নিজেকে ফিট রেখে আরও কিছুদিন খেলে যেতে পারতেন বলে একটা আক্ষেপ থাকলেও এই বাহাতি নিজেকে দলের বোঝা বানাতে চানননি।
পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ওঠা অনেক অভিযোগই তাকে যে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, অবসর ঘোষনা দেবার পেছনে এটা একটা বড় কারণ। তবে সাকিব যে ধাতুতে তৈরি তাতে করে অবসর নেবার সিদ্বান্তটি একজন সতীর্থর সাথে আলোচনা করেননি। নিজের সিদ্বান্ত নিজে নিয়ে শেষ বেলায়ও আলাদা পরিচয় দিয়েছেন।
১. সাকিব আল হাসান নামটির সাথে সাফল্য আর বিতর্ক যেন হাত ধারধরি করেই হেটেছে। তবে যেভাবেই হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাথে এই নামটি দীর্ঘদিন উচ্চারিত হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুথে যখন ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় তখন ক্রিকেটার সাকিব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টি-টেন লিগ লেখতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশে ছেড়েছিলেন তারও মাসখানেক আগে। এরপরই উড়াল দেন কানাডায়। সেখানে গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে নিজেকে পাকিস্তান সফরের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। তবে বেশি বিতর্ক ছড়িয়েছেন কানাডায় পার্কে ঘুরে পরিবারের সাথে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। প্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দলে থেকে প্রথমবার সিরিজ জয়ে দারুণ ভুমিকা রেখেছিলেন। মাঠের কোচ সাকিব, এমন একটা অবস্থাও সেই সিরিজে বোঝা গেছে। এরপর কাউন্টি খেলতে চলে যান ইংল্যান্ডে। এক ম্যাচ খেলে যোগ দেন ভারতের বিপক্ষে দলে। যদিও পাকিস্তানের বিপক্ষে পাওয়া সাফল্যটা বিসর্জন দিয়েছেন ভারতে এসে। এরপর আবারও উড়াল দেন ইংল্যান্ডে।
২. পাকিস্তানে বিপক্ষে খেলার সময়ই দেশে তার নামে হত্যা মামলা হয়। যদিও মাগুড়ার সংসদ সদস্য হওয়ার পরও তার নামে মামলা হয় রাজধানী ঢাকায়। এই ঘটনার পর বাড়তে থাকা অস্বস্থি থেকে যেন মুক্তি মিলছিলনা। মাঠের ক্রিকেটটা ঠিকঠাক খেলতে পারলেও শরীরি ভাষায় স্পষ্ট ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। দেশে শোরগোল পড়ে যায়, কিভাবে হত্যা মামলার আসামী জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারেন? তবে সাকিবকে দলের প্রয়োজনেই দেশের জার্সি গায়ে খেলে যেতে হয়েছিল। দেশে ফেরার মতো অবস্থা না থাকায় চলছিল নানা আলোচনা-সমালোচনা। পরিবার মার্কিন মুলুকে থাকায় আর নিজেরও দেশটির ভিসা থাকায় তার কোন সমস্যা না হলেও আড়ালে হওয়া সমালোচনাগুলো বেশ শুনতে পেতেন এই মিষ্টার অলরাউন্ডার। চেন্নাইয়ে প্রথম টেস্টটা ঠিকঠাক খেলতে পারলেও দ্বিতীয় টেস্টেও আগে এমন এক সিদ্বান্ত নিলেন যা তার সতীর্থ থেকে শুরু করে টিম ম্যানেজমেন্টের কেউই জানতেন না। এমনকি জীবনের অনেক সিদ্বান্ত যে কোচের সাথে পরামর্শ করে নিতেন সেই মোহাম্মদ সালাউদ্দিনও ছিলেন অন্ধকারে। সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষনা দেওয়ার পর অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় সংবাদিকরাও।
৩. মূলত জনসেবার (!) নেশায় একজন জনপ্রতিনিধি হয়েই জীবনের শেষ ভুলটা করেন সাকিব, এমন মত অধিকাংশ ক্রিকেট ভক্তের। যদিও দারুণ এ দুঃসময়ে তার পাশেই থাকছেন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ভক্ত সমর্থকরা। এক রাজনীতিই নায়ক সাকিবকে ভিলেন বানাতে এতটুকু সময় নেননি। সংসদ সদস্য হয়ে নিজের বাড়িতে দেওয়া আগুনে ট্রফিসহ অনেক স্মৃতি হারিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। সাকিবকে সে অবস্থায় পড়তে না হলেও প্রিয় দেশই এখন তার কাছে এক আতংকের নাম। দেশে ফিরতে নিশ্চয়তা চাইছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে দেশ থেকে বের হতে। আর তাতেই দেশের মাটিতে শেষ টেস্ট খেলার অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপ দেখতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে যদিও ইতিবাচক কথা বলেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুইয়া। যদিও এই কথার উপর ভরসা করে সাকিব দেশে আসবেন কিনা সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে উর্বর মস্তিস্কের এই ক্রিকেটার চাইলে আরও কয়েক বছর অনায়াসে কেলে যেতে পারতেন, কিন্তু সময় তাকে বিদায় বলতে বাধ্য করেছে একরকম। তবে সাকিব যে ধাতুতে তৈরি তাকে বিদায় বেলায় আবেক আপ্লুত হলেও বলার তেমন কিছু ছিলনা। নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কোন আক্ষেপ নেই বলেও পরিস্কার জানিয়েছেন।
৪. দেশের ক্রিকেটে তিন দফা অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন সাকিব, যার মধ্যে দুটো বিশ^কাপ রয়েছে। একটি ২০১১ সালে দেশের মাটিতে আরেকটি ২০২৩ সালে ভারতে। একটা সময় ছোট দেশের বড় তারকার খেতাব পাওয়া সাকিব বিশ^ ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে দীর্ঘ সময় শীর্ষ থাকা একজন। ওয়ানডে ক্রিকেটে টানা ১৭৩৯ দিন (৭ মে ২০১৯ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) এক নম্বর অলরাউন্ডার ছিলেন এই সুপারষ্টার। তাঁর মতো এত লম্বা সময় আইসিসির এই অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ছিলেন না আর কোন খেলোয়াড়ই। সাকিবের এই অনন্য স্বীকৃতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ২০০৭ সালে অভিষেকের পর থেকে তাঁর অগ্রগামী যাত্রায় গর্বিত হয়েছিল পুরো দেশ। ২০০৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গিয়ে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দও ভাগাভাগি করে নিয়েছিল সবাই। মাত্র ২২ বছর ১১৫ দিন বয়সী সাকিব টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক (সেই সময়ের রেকর্ড) হিসেবে নিজেকে চিনিয়েছিলেন বিশ্বক্রিকেটের সামনে। দাপিয়ে বেড়ানো সেই থেকে শুরু।
৫. অনেকগুলো রেকর্ডে সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য অবস্থানে। যার মধ্যে রয়েছে ১৪০০০ রান ও ৭০০ উইকেটের ডাবল। দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সব আসরেই অংশগ্রহণ করার মতো বিরল কৃতিত্ব। সবচেয়ে বেশি সিরিজসেরা হওয়ার অনন্য গৌরবও তার দখলে রয়েছে। বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক ২০০৯-এর ১৭ জুলাই গ্রেনাডার সেন্ট জর্জেস গ্রাউন্ডে ২২ বছর ১১৫ দিন বয়সে টেস্টে অধিনায়ক সাকিবের অভিষেক হয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক ভেন্যুতে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড সাকিবের। মিরপুরের শেরেবাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে তিন সংস্করণ মিলে ১৪৪ ম্যাচে নিয়েছেন ২৫২ উইকেট। যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ দিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছেন, সাকিবের কাছে রেকর্ডটা আরও একটু বাড়ানোর সুযোগ থাকছে।
৬. এত অর্জনের সাকিবকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করাই যায়। তবে যদি দেখা যায় মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা বিতর্কিত করে বেড়িয়েছেন তখন নিজের অবস্থান কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে যায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর ব্যবসায়িক ক্যারিয়ার সমালোচিত করেছে অর্জনে পরিপূর্ন সামগ্রিক সত্তাকেই। ক্রিকেটের বিশ্বমঞ্চে যে সাকিব হতে পারতেন নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শিক একজন, সেই তিনিই কিনা ক্রিকেটের বাইরের জীবনে মনোযোগী হয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন। হোটেল ব্যবসা থেকে শুরু করে কাঁকড়ার খামার, অর্থের বিনিময়ে অনুশীলন ফেলে যে কোনো শোরুম উদ্বোধন থেকে কলকাতায় পূজামন্ডপে গিয়ে প্রদীপ জ্বালানো, শেয়ারবাজারে কারসাজি, মিরপুরের গ্যালারিতে দর্শকের গায়ে হাত আর সমর্থকদের মধ্যে রূঢ় সাকিবকে নিয়ে একটা অস্বস্থি ছিলই। তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয়কে তাঁর ক্রিকেটীয় অবদানের কারণেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে অনেকেই অনুরোধ জানিয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শত শত প্রাণ ঝড়ে গেলে এখনো টু শ^দটি করেননি। ফিক্সিংকান্ডে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছেন ভক্তকুল, সে কারণেই বহু বিতর্কের পরও থাকবেন স্বরণীয় হয়ে।